শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

পাটবীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা ৫ বছরে

মামুন বাবু ## মানসম্মত পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে পাঁচবছরের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত পাটবীজ উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে। প্রয়োজনীয় পাটবীজ সংগ্রহে আমদানি নির্ভরতা আর থাকবে না। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২১ সাল থেকে। ধাপে ধাপে তা আগামী পাঁচবছরে শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। ইতিমধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ রোডম্যাপটি চূড়ান্ত করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দেশি, ও তোষা এই দুই জাতের পাট চাষ করা হয়। তবে কেনাফ ও মেসতা জাতের পাটও বাংলাদেশে চাষ করা হয়, যার মান ততটা উন্নত নয়। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে এই পরিমাণ পাট উৎপাদনে পাটবীজের প্রয়োজন ৬ থেকে ৭ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পাটবীজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এর মধ্যে তোষাপাট উন্নত জাতের হওয়ায় এর চাহিদা ব্যাপক। যা জেআর-৫২৪ জাতের পাট নামে পরিচিত।
সূত্র আরও জানায়, ভারত থেকে যে পাটবীজ আমদানি করা হয় সেটি জেআরও-৫২৪ জাতের। এটিই তোষাপাট নামে পরিচিত। এর বিকল্প হিসেবে গত ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) তোষা -৮ (রবি-১) নামে পাটের একটি নতুন জাত অবমুক্ত করেছে। এটি ভারতীয় তোষা জাতের পাটের চেয়েও উন্নত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন জাত বলে কৃষকরা ভরসা রাখতে পারছে না দেশে উদ্ভাবিত নতুন তোষা-৮ জাতের পাট ও তার বীজের উপর। তারা আমদানিকৃত ভারতের জেআর-৫২৪ জাতের পাট চাষেই আগ্রহী বেশি। আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভারতীয় জেআর-৫২৪ জাতের পাটের তুলনায় দেশে উদ্ভাবিত তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটচাষে কৃষকদের লাভবান করতেই মূলত ৫ বছরের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাবনার চাটমোহর উপজেলার পাটচাষি মোহম্মদ শাহীন আহমেদ বলেন, নতুন বীজ রোপণ করে ঝুঁকি নিতে চাই না, যদি ফসল মার খায়? এ কারণেই ভারতীয় বীজের প্রতি আগ্রহ বেশি। আমরা তো ভারতীয় বীজের বিকল্প অন্য কোনও বীজ লাগাইনি। নতুন জাতের রবি-১ বীজটি এখনও সেভাবে কৃষকদের মাঝে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। এই বীজের প্রতি আস্থা আসতে কিছুটা সময় লাগবে। যদি বাংলাদেশের উদ্ভাবিত তোষাপাট-৮ বা রবি-১ জাতের পাটবীজ ভালো হয় তাহলে আমরা তা ব্যবহার করবো। কারণ আমদানিকৃত বীজের দাম বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে এক সময় দেশি পাটের বীজ দেশের কৃষকরাই উৎপাদন করতো। সাধারণত কৃষক পাট ক্ষেতের একাংশ পাট বীজ উৎপাদনের জন্য রাখতো। এ পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহে সময় লাগে ১০ থেকে ১১ মাস। এই সমস্যা সমাধানে বিজেআরআই ‘নাবী পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তির’ মাধ্যমে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর— মাত্র এই চার মাসে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু এই সময়ে মাঠে বেশি দামের রবিশস্য চাষ না করে পাটচাষে আগ্রহী হয় না কৃষক। ফলে চাহিদা বিবেচনায় তোষাপাট বীজ উৎপাদন বাড়েনি। এ কারণে বহুবছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে পাটবীজ আমদানি করে চাহিদা মিটিয়েছে বাংলাদেশ। যদি কোনও কারণে পাটবীজ আমদানি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে সারাবছরের জন্য অর্থকরী এই ফসলটির উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। যা অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসতেই অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এর ফলেই তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটের জাত উদ্ভাবন করেছে বিজেআরআই। বিজেআরআই বলেছে, এই জাতের পাট ১৫ থেকে ২০ ফুট লম্বা হয় বলে উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। এতে কৃষকরাই লাভবান হবেন।
বিজেআরআই সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তোষা পাট চাষের আওতাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ জমিতে আমদানি করা ভারতের জেআরও-৫২৪ জাতের পাট চাষ করা হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটের নতুন জাত বিজেআরআই তোষাপাট-৮ (রবি-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে এর ফলন হেক্টর প্রতি ৩ দশমিক ৩৩ থেকে ৩ দশমিক ৭২ টন পর্যন্ত। যা প্রচলিত উন্নত জাত অপেক্ষা চার থেকে ২৪ শতাংশ এবং ভারতের জেআরও-৫২৪ জাত অপেক্ষা ৫ থেকে ১১ শতাংশ বেশি। উচ্চ ফলনশীল বিজেআরআই রবি-১ জাতটি পাটচাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় করণের লক্ষ্যে গত ২০২০ সালের পাট মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩ হাজার ৪০০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন এবং পাটচাষিদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ দিবস পালন করা হয়েছে।  এসব কর্মসূচিতে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে বলে নিজস্ব পাটের নতুন জাত রবি-১ (বিজেআরআই তোষা-৮) কে কার্যকরভাবে সম্প্রসারিত করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই ৫ বছরের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাট একটি নোটিফাইড শস্য। পাটবীজ উৎপাদনের মৌলিক ধাপ তিনটি। এগুলো হচ্ছে- ১. প্রজনন বীজ। ২. ভিত্তি বীজ ও ৩. প্রত্যায়িত বীজ।  বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, ১. প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত শতভাগ কৌলিত্বাত্তিক দিক থেকে বিশুদ্ধ বীজকেই প্রজনন বীজ নামে পরিচিত। ২. প্রজনন বীজকে বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ভিত্তি বীজ। সরাসরি বা গবেষণা খামারে গবেষক বা কৃষিতত্ত্ববিদ এবং বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এই বীজ উৎপাদন করা হয়। আর ৩. ভিত্তিবীজ বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় প্রত্যায়িত বীজ। এই বীজই কৃষকদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সি এই বীজের সনদ প্রদান করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ করা হয়েছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। সে হিসেব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালের জমির পরিমাণকে ভিত্তি ধরে বীজ উৎপাদনের চাহিদা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি হিসাব করা হয়েছে। ভিত্তিবছর অনুযায়ী তোষাপাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ৬ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রয়োজন হবে চার হাজার ৩৯১ টন প্রত্যায়িত বীজের (প্রতি হেক্টরে ৬ দশমিক ৫ কেজি হিসেবে)। চার হাজার ৩৯১ মেট্রিকটন বীজের জন্য প্রয়োজন হবে ৫৮ দশমিক ৫৪ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজের। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এই পরিমাণ বীজ উৎপাদন করবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএজআরআই) এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
পাট বীজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ ৫ বছর মেয়াদি যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে—প্রথম বছর ২০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এর জন্য পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এ দিয়ে ১ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে এ ক্ষেত্রেও নিবিড় পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের কাছে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
তৃতীয় বছর বাড়িয়ে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে ২ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ একই পদ্ধতিতে পাটচাষিদের বিতরণ করা হবে। প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী চতুর্থ বছর একইভাবে বিজেআরআই’র সরবরাহ করা প্রজনন বীজের মাধ্যমে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ৪ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে সরকার। যা বিনামূল্যে নয়, ভর্তুকি মূল্যে প্রতিকেজি বীজের মূল্য ১০০ টাকা দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে। এ ক্ষেত্রেও ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম বছর আরও ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চার হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। এটিও ভর্তুকি মূল্যে ১০০ টাকা কেজি দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পাটবীজ এখনও আমদানি নির্ভর। যার পুরোটাই ভারত থেকে আসে। যে কারণে এই খাতের চ্যালেঞ্জ রয়েই যায় সব সময়। কোনও কারণে পাটবীজ আমদানি বাধাগ্রস্ত হলে পুরো অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত পাটের বিপর্যয় সুনিশ্চিত। তাই ঝুঁকিতে না থেকে পাটবীজ উৎপাদনে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী পাঁচবছরে বাংলাদেশ উন্নতমানের পাটবীজ উৎপাদনে সক্ষম হবে। আগামীতে পাটের সোনালী দিন অপেক্ষা করছে বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ হাজরা জানিয়েছেন, রোড ম্যাপ অনুযায়ী ৫ বছর নয় বর্তমান সরকারের এই মেয়াদেরে মধ্যেই অর্থাৎ আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত তোষাপাট-৮ জাতের উন্নত মানের বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হবে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে এক কেজি পাটের বীজও আমদানি করার দরকার হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে বলাই কৃষ্ণ হাজরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভারত থেকে পেঁয়াজের বীজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তবে পাট বীজ রফতানিতে ভারত সরকারের কোনও নেগেটিভ সিদ্ধান্ত নেই।

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

পাটবীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা ৫ বছরে

প্রকাশের সময় : ০১:১৪:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী ২০২১
মামুন বাবু ## মানসম্মত পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে পাঁচবছরের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি করেছে সরকার। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত পাটবীজ উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে। প্রয়োজনীয় পাটবীজ সংগ্রহে আমদানি নির্ভরতা আর থাকবে না। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ২০২১ সাল থেকে। ধাপে ধাপে তা আগামী পাঁচবছরে শতভাগ বাস্তবায়ন করা হবে। ইতিমধ্যেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ রোডম্যাপটি চূড়ান্ত করেছে। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দেশি, ও তোষা এই দুই জাতের পাট চাষ করা হয়। তবে কেনাফ ও মেসতা জাতের পাটও বাংলাদেশে চাষ করা হয়, যার মান ততটা উন্নত নয়। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে প্রতিবছর ৭০ থেকে ৭৫ লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়। বাংলাদেশে এই পরিমাণ পাট উৎপাদনে পাটবীজের প্রয়োজন ৬ থেকে ৭ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ পাটবীজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এর মধ্যে তোষাপাট উন্নত জাতের হওয়ায় এর চাহিদা ব্যাপক। যা জেআর-৫২৪ জাতের পাট নামে পরিচিত।
সূত্র আরও জানায়, ভারত থেকে যে পাটবীজ আমদানি করা হয় সেটি জেআরও-৫২৪ জাতের। এটিই তোষাপাট নামে পরিচিত। এর বিকল্প হিসেবে গত ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) তোষা -৮ (রবি-১) নামে পাটের একটি নতুন জাত অবমুক্ত করেছে। এটি ভারতীয় তোষা জাতের পাটের চেয়েও উন্নত বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন জাত বলে কৃষকরা ভরসা রাখতে পারছে না দেশে উদ্ভাবিত নতুন তোষা-৮ জাতের পাট ও তার বীজের উপর। তারা আমদানিকৃত ভারতের জেআর-৫২৪ জাতের পাট চাষেই আগ্রহী বেশি। আমদানি নির্ভরতা কমাতে ভারতীয় জেআর-৫২৪ জাতের পাটের তুলনায় দেশে উদ্ভাবিত তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটচাষে কৃষকদের লাভবান করতেই মূলত ৫ বছরের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পাবনার চাটমোহর উপজেলার পাটচাষি মোহম্মদ শাহীন আহমেদ বলেন, নতুন বীজ রোপণ করে ঝুঁকি নিতে চাই না, যদি ফসল মার খায়? এ কারণেই ভারতীয় বীজের প্রতি আগ্রহ বেশি। আমরা তো ভারতীয় বীজের বিকল্প অন্য কোনও বীজ লাগাইনি। নতুন জাতের রবি-১ বীজটি এখনও সেভাবে কৃষকদের মাঝে পৌঁছাতে পারেনি সরকার। এই বীজের প্রতি আস্থা আসতে কিছুটা সময় লাগবে। যদি বাংলাদেশের উদ্ভাবিত তোষাপাট-৮ বা রবি-১ জাতের পাটবীজ ভালো হয় তাহলে আমরা তা ব্যবহার করবো। কারণ আমদানিকৃত বীজের দাম বেশি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশে এক সময় দেশি পাটের বীজ দেশের কৃষকরাই উৎপাদন করতো। সাধারণত কৃষক পাট ক্ষেতের একাংশ পাট বীজ উৎপাদনের জন্য রাখতো। এ পদ্ধতিতে বীজ সংগ্রহে সময় লাগে ১০ থেকে ১১ মাস। এই সমস্যা সমাধানে বিজেআরআই ‘নাবী পাট বীজ উৎপাদন প্রযুক্তির’ মাধ্যমে বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর— মাত্র এই চার মাসে উন্নত মানের বীজ উৎপাদনে সক্ষম। কিন্তু এই সময়ে মাঠে বেশি দামের রবিশস্য চাষ না করে পাটচাষে আগ্রহী হয় না কৃষক। ফলে চাহিদা বিবেচনায় তোষাপাট বীজ উৎপাদন বাড়েনি। এ কারণে বহুবছর ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে পাটবীজ আমদানি করে চাহিদা মিটিয়েছে বাংলাদেশ। যদি কোনও কারণে পাটবীজ আমদানি বাধাগ্রস্ত হয় তাহলে সারাবছরের জন্য অর্থকরী এই ফসলটির উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। যা অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ আশঙ্কা থেকে বেরিয়ে আসতেই অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। এর ফলেই তোষা-৮ বা রবি-১ নামের পাটের জাত উদ্ভাবন করেছে বিজেআরআই। বিজেআরআই বলেছে, এই জাতের পাট ১৫ থেকে ২০ ফুট লম্বা হয় বলে উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। এতে কৃষকরাই লাভবান হবেন।
বিজেআরআই সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে তোষা পাট চাষের আওতাধীন জমির পরিমাণ প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ জমিতে আমদানি করা ভারতের জেআরও-৫২৪ জাতের পাট চাষ করা হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিজেআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত পাটের নতুন জাত বিজেআরআই তোষাপাট-৮ (রবি-১) নামে অবমুক্ত করা হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে এর ফলন হেক্টর প্রতি ৩ দশমিক ৩৩ থেকে ৩ দশমিক ৭২ টন পর্যন্ত। যা প্রচলিত উন্নত জাত অপেক্ষা চার থেকে ২৪ শতাংশ এবং ভারতের জেআরও-৫২৪ জাত অপেক্ষা ৫ থেকে ১১ শতাংশ বেশি। উচ্চ ফলনশীল বিজেআরআই রবি-১ জাতটি পাটচাষিদের মধ্যে জনপ্রিয় করণের লক্ষ্যে গত ২০২০ সালের পাট মৌসুমে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট এর তত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৩ হাজার ৪০০টি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন এবং পাটচাষিদের নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মাঠ দিবস পালন করা হয়েছে।  এসব কর্মসূচিতে কৃষকদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে বলে নিজস্ব পাটের নতুন জাত রবি-১ (বিজেআরআই তোষা-৮) কে কার্যকরভাবে সম্প্রসারিত করা সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এ কারণেই ৫ বছরের জন্য রোডম্যাপ তৈরি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাট একটি নোটিফাইড শস্য। পাটবীজ উৎপাদনের মৌলিক ধাপ তিনটি। এগুলো হচ্ছে- ১. প্রজনন বীজ। ২. ভিত্তি বীজ ও ৩. প্রত্যায়িত বীজ।  বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়েছে, ১. প্রজননবিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত শতভাগ কৌলিত্বাত্তিক দিক থেকে বিশুদ্ধ বীজকেই প্রজনন বীজ নামে পরিচিত। ২. প্রজনন বীজকে বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় ভিত্তি বীজ। সরাসরি বা গবেষণা খামারে গবেষক বা কৃষিতত্ত্ববিদ এবং বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সির কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এই বীজ উৎপাদন করা হয়। আর ৩. ভিত্তিবীজ বর্ধিত করে যে বীজ পাওয়া যায় তাকে বলা হয় প্রত্যায়িত বীজ। এই বীজই কৃষকদের মাঝে চাষের জন্য বিতরণ করা হয়। বীজ প্রত্যায়ন এজেন্সি এই বীজের সনদ প্রদান করে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাটচাষ করা হয়েছে। যা গত কয়েক বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ। সে হিসেব অনুযায়ী ২০১৭-১৮ সালের জমির পরিমাণকে ভিত্তি ধরে বীজ উৎপাদনের চাহিদা এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি হিসাব করা হয়েছে। ভিত্তিবছর অনুযায়ী তোষাপাট বীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য ৬ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর জমিতে প্রয়োজন হবে চার হাজার ৩৯১ টন প্রত্যায়িত বীজের (প্রতি হেক্টরে ৬ দশমিক ৫ কেজি হিসেবে)। চার হাজার ৩৯১ মেট্রিকটন বীজের জন্য প্রয়োজন হবে ৫৮ দশমিক ৫৪ মেট্রিক টন ভিত্তি বীজের। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) এই পরিমাণ বীজ উৎপাদন করবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএজআরআই) এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
পাট বীজ উৎপাদনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগ ৫ বছর মেয়াদি যে রোডম্যাপ তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে—প্রথম বছর ২০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এর জন্য পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
দ্বিতীয় বছর ৪০ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে। এ দিয়ে ১ হাজার ৪৬৪ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে এ ক্ষেত্রেও নিবিড় পাট উৎপাদন এলাকায় ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ বিনামূল্যে পাটচাষিদের কাছে বিনা মূল্যে বিতরণ করা হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
তৃতীয় বছর বাড়িয়ে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদন করা হবে যা দিয়ে ২ হাজার ৯২৭ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করা হবে। একইভাবে ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে এবং উৎপাদিত বীজ একই পদ্ধতিতে পাটচাষিদের বিতরণ করা হবে। প্রজনন বীজ বিজেআরআই সরবরাহ করবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী চতুর্থ বছর একইভাবে বিজেআরআই’র সরবরাহ করা প্রজনন বীজের মাধ্যমে ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় ৪ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদন করতে সক্ষম হবে সরকার। যা বিনামূল্যে নয়, ভর্তুকি মূল্যে প্রতিকেজি বীজের মূল্য ১০০ টাকা দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে। এ ক্ষেত্রেও ৩ হাজারটি প্রদর্শনী প্লট স্থাপন করা হবে।
রোডম্যাপ অনুযায়ী সর্বশেষ পঞ্চম বছর আরও ৫৯ মেট্রিক টন ভিত্তিবীজ উৎপাদনের মধ্য দিয়ে শতভাগ অর্থাৎ প্রয়োজনীয় চার হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন প্রত্যায়িত বীজ উৎপাদনের সক্ষমতা নিশ্চিত করা হবে। এটিও ভর্তুকি মূল্যে ১০০ টাকা কেজি দরে পাটচাষিদের কাছে বিক্রি করা হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম জানিয়েছেন, বাংলাদেশের পাটবীজ এখনও আমদানি নির্ভর। যার পুরোটাই ভারত থেকে আসে। যে কারণে এই খাতের চ্যালেঞ্জ রয়েই যায় সব সময়। কোনও কারণে পাটবীজ আমদানি বাধাগ্রস্ত হলে পুরো অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত পাটের বিপর্যয় সুনিশ্চিত। তাই ঝুঁকিতে না থেকে পাটবীজ উৎপাদনে রোডম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী পাঁচবছরে বাংলাদেশ উন্নতমানের পাটবীজ উৎপাদনে সক্ষম হবে। আগামীতে পাটের সোনালী দিন অপেক্ষা করছে বলেও জানান তিনি।
অপরদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ অণুবিভাগের মহাপরিচালক বলাই কৃষ্ণ হাজরা জানিয়েছেন, রোড ম্যাপ অনুযায়ী ৫ বছর নয় বর্তমান সরকারের এই মেয়াদেরে মধ্যেই অর্থাৎ আগামী তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত তোষাপাট-৮ জাতের উন্নত মানের বীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হবে। রোডম্যাপ বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে এক কেজি পাটের বীজও আমদানি করার দরকার হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে বলাই কৃষ্ণ হাজরা জানিয়েছেন, বর্তমানে ভারত থেকে পেঁয়াজের বীজ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তবে পাট বীজ রফতানিতে ভারত সরকারের কোনও নেগেটিভ সিদ্ধান্ত নেই।