বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্রাহকের দেড় কোটি টাকা নিয়ে উধাও ’সিরাক বাংলাদেশ’

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি ।।
১০ শতক জমি বন্ধক রেখে মরিচ ও সবজি চাষ করে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছিলেন দিনমজুর বাচ্চু শেখ। সিরাক বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওর প্রলোভনে পড়ে বন্ধক রাখা জমিটিও আবারও অন্যের কাছে বন্ধক রাখেন। সেই টাকা এনজিও কর্মীদের কাছে জামানত রাখেন মোটা অংকের ঋণের আশায়। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে জানতে পারেন, এনজিও কর্মীরা তাদের গ্রামের আরও ১৫ জনের ভর্তি ও জামানতের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, উপজেলার কয়েকটি গ্রাম থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার শৈলকুপা পৌরসভার সিটিকলেজ রোডের পাশে সিরাক বাংলাদেশ নামে এনজিওটির অফিস। সংস্থাটি শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামের দিনমজুর ও অসচ্ছল পরিবারকে মোটা অংকের ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
জানা গেছে, সিরাক বাংলাদেশ ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের অফিসের কার্যক্রম শুরু করে। ১ অক্টোবর ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে টাকা আদায় শুরু করে। কিন্তু নির্ধারিত দিনে গ্রাহক অফিসে গিয়ে দেখতে পান গেটে তালা ঝুলছে।
গ্রাহকরা বলছেন, সাজানো-গোছানো অফিস আর সাইনবোর্ড দেখে তারা টাকা জামানত রেখেছেন। সহজ শর্তে ঋণের আশায় কেউ কেউ পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জামানত রেখেছেন। এখন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিদিন তালাবদ্ধ অফিসের সামনে গিয়ে ভিড় করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শৈলকুপা পৌরসভার সিটিকলেজ রোডের গ্রিস প্রবাসী আকবর হোসেনের বাড়ি ভাড়া নেয় এনজিও নামধারী একদল প্রতারক। কবিরপুর এলাকার সিটি কলেজ সড়কে একটি একতলা বাড়ির মূল ফটকের সামনে সাইনবোর্ড। তবে ফটকটি তালাবদ্ধ। সাইনবোর্ডটিতে লেখা আছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সিরাক বাংলাদেশ, ক্ষুদ্র ঋণ দান ও কুটির শিল্প প্রকল্প’। অফিসের সামনে দুই একজন আসা-যাওয়া করছেন। তারা ঋণ পাওয়ার আশায় টাকা জামানত রেখে এখন ঘুরছেন।
স্থানীয়রা জানায়, মাসিক চার হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া নেয় তারা। এক বছরের টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা ছিল। গত মাসের ২৫ সেপ্টেম্বর বাসার গেটে সিরাক বাংলাদেশ  নামে একটি সাইনবোর্ড লাগায় তারা। ১ অক্টোবর তাদের ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা ছিল।
জানা গেছে, এক সপ্তাহে তারা কয়েকশ মানুষের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার নাম করে ৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে। এ  ঘটনায় শৈলকুপা থানায় এনজিও কর্মী নাজমুলকে প্রধান আসামি করে উপজেলার হড়রা গ্রামের প্রতারণার শিকার রুহুল আমিন মামলা দায়ের করেছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা আবাইপুর গ্রামের সিটি কলেজ পাড়ার বাসিন্দা জাহানারা খাতুন। তার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তিনিও সিরাক বাংলাদেশের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মেয়ের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণের আশায় ১৫ হাজার ২৫০ টাকা দিয়েছেন ওই সংস্থার নাজমুল নামে এক কর্মীর কাছে। টাকা হারিয়ে এখন তিনি বাকরুদ্ধ।
উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের হাসি খাতুন জানান, একই গ্রামের লাভলী খাতুন প্রথমে তাকে সিরাক বাংলাদেশের কথা বলে। এরপর কেন্দ্রে গেলে এনজিও কর্মী তাকে ২৫০ টাকা ফি দিয়ে ভর্তি হতে বলে। তখন তিনি টাকা দিয়ে ভর্তি হন। এক দিন পরে তারা বলে, আপনি কত টাকা নিবেন ৫০ হাজার না ১ লাখ। তখন আমি বলি আপনারা আগে অন্যদের ঋণ দেন, তারপর আমরা নেব। পরের দিন সকালে আমাকে বলে, আপনার ছেলে আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। এ জন্য আপনাদের সদস্যই বাতিল করা হয়েছে। তখন আমাদের ভর্তির টাকা ফেরত দেন।
শ্রীমতি অঞ্জনা রাণী জানায়, তিনি প্রতিবেশীর কথা শুনে ওই এনজিওতে ২৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি হন। এরপর অনেক কষ্টে ধার করে ৫০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ৫ হাজার টাকা সঞ্চয় দেন। অক্টোবরের এক তারিখে তাদের ঋণ বিতরণের কথা ছিল। ঋণ নিতে গিয়ে দেখি অফিসে তালা ঝুলছে। টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে প্রতারক চক্র।
মোছা. রাবেয়া খাতুন জানায়, এনজিও কর্মীরা তাদের ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখায় । এই প্রলোভনে পড়ে তিনিসহ তার সমিতির পাঁচজন ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন। কেউ কেউ পাঁচ হাজার টাকা করে জমা দেন। এনজিও কর্মীরা তাদের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
গোবিন্দপুর গ্রামের লাভলী খাতুন জানান, সিরাক বাংলাদেশ প্রথমে আমাদের বাড়িতে আসে কেন্দ্র করার জন্য। কারণ আমাদের বাড়িতে আরও কয়েকটি এনজিওর কেন্দ্র রয়েছে। আমার বাড়িতে দুটি এনজিওর কেন্দ্র থাকায় তাদেরও কেন্দ্র করার অনুমতি দেই। এ সময় তারা আমাকে বলে, আমাদের কিছু ভালো সদস্য দেন যাদের আমরা বিনা জামানতে ঋণ দেবো। তখন আমি আশপাশের নারীদের সঙ্গে কথা বলে সদস্য জোগাড় করি।
এরপর ওই এনজিও কর্মীরা বলেন, তাদের থেকে ঋণ নিতে হলে ১ লাখে ১০ হাজার টাকা করে জমা দিতে হবে। এরপর আমাদের বন্ধক রাখা জমিটি আবারও অন্যের কাছে বন্ধক দিয়ে ১০ হাজার টাকা জমা দেই। আমার দেখাদেখি অন্যরাও সঞ্চয়ের টাকা জমা দেন। এরপর ১ অক্টোবর তারা ঋণ বিতরণের কথা বলেন। আমরা নির্ধারিত দিনে টাকা নিতে গিয়ে দেখি অফিসে তালা ঝুলছে। আমরা  কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে আসি। পরের দিন আবার যাই। কিন্তু তাদের দেখা পায় না। তৃতীয় দিনে আমরা আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, এখানে যারা ছিল তারা চলে গেছে।
কবিরপুর এলাকার মনিরুল ইসলাম জানায়, সংস্থাটির কর্মকর্তারা এলাকায় বেশি পরিচিত নয়। মাত্র সাত দিন এখানে ছিল। তারা বেশির ভাগ সময় অফিসের মধ্যেই থেকেছেন। বাইরে শুধু অর্থ সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছেন। নামজুল হোসেন নিজেকে সংস্থার প্রধান বলে পরিচয় দেন।
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন দলে দলে গ্রাহক আসছেন। তারা ক্ষোভের কথা বলছেন। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, কর্মকর্তারা সহস্রাধিক মানুষের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোনগুলোও বন্ধ।
সিরাক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত মুঠোফোনে জানিয়েছেন, তাদের সংস্থার ঝিনাইদহ জেলাতে কোনো শাখা নেই।এ ছাড়া তারা ঋণদান কর্মসূচি বাস্তবায়নও করেন না। তাদের সংস্থার নাম ব্যবহার করে একটি চক্র প্রতারণা করছে বলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাধ্যমে তিনিও জানতে পেরেছেন।তিনি আরও জানান, প্রতারক চক্র এমআরএ নিবন্ধন সনদ নম্বর ব্যবহার করেছে সাইনবোর্ডে, যা তাদের নয়। তাদের সংস্থা এমআরএ নিবন্ধিত নয়। তিনি দাবি করেন, একটি প্রতারক চক্র তাদের সংস্থার নাম ও লোগো ব্যবহার করে এ প্রতারণা করেছেন। এ নিয়ে তারা মিরপুরের পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল সামী  বলেন, সিরাক বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামে ঋণ দেওয়ার নাম করে গরিব ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের কাছ থেকে জামানতের নামে টাকা নিয়েছেন। তারা ওই এলাকায় এক সপ্তাহের জন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এলাকার লোকজন প্রতারিত হওয়ার পর অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা সেখান থেকে তাদের অফিস গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। পরে আমরা জানতে পারি, সিরাক বাংলাদেশ নামে যে এনজিওটির পরিচয় পাওয়া গেছে সেটি আসলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে ময়মনসিংহ জেলায় নিবন্ধিত আছে। যার ঝিনাইদহ জেলার কোথাও কাজকর্ম করার কোনো বৈধতা নেই।
একটি অসাধু চক্র এই নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে। যদি কোনো এনজিও বা সংস্থার ঝিনাইদহে কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয় তাহলে অবশ্যই তাদের ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কার্যলয় থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হবে।

গ্রাহকের দেড় কোটি টাকা নিয়ে উধাও ’সিরাক বাংলাদেশ’

প্রকাশের সময় : ০৪:২৮:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি ।।
১০ শতক জমি বন্ধক রেখে মরিচ ও সবজি চাষ করে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছিলেন দিনমজুর বাচ্চু শেখ। সিরাক বাংলাদেশ নামে একটি এনজিওর প্রলোভনে পড়ে বন্ধক রাখা জমিটিও আবারও অন্যের কাছে বন্ধক রাখেন। সেই টাকা এনজিও কর্মীদের কাছে জামানত রাখেন মোটা অংকের ঋণের আশায়। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে জানতে পারেন, এনজিও কর্মীরা তাদের গ্রামের আরও ১৫ জনের ভর্তি ও জামানতের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, উপজেলার কয়েকটি গ্রাম থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন মোটা অংকের টাকা।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার শৈলকুপা পৌরসভার সিটিকলেজ রোডের পাশে সিরাক বাংলাদেশ নামে এনজিওটির অফিস। সংস্থাটি শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামের দিনমজুর ও অসচ্ছল পরিবারকে মোটা অংকের ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
জানা গেছে, সিরাক বাংলাদেশ ২৫ সেপ্টেম্বর তাদের অফিসের কার্যক্রম শুরু করে। ১ অক্টোবর ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে টাকা আদায় শুরু করে। কিন্তু নির্ধারিত দিনে গ্রাহক অফিসে গিয়ে দেখতে পান গেটে তালা ঝুলছে।
গ্রাহকরা বলছেন, সাজানো-গোছানো অফিস আর সাইনবোর্ড দেখে তারা টাকা জামানত রেখেছেন। সহজ শর্তে ঋণের আশায় কেউ কেউ পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত জামানত রেখেছেন। এখন টাকা ফেরত পাওয়ার আশায় প্রতিদিন তালাবদ্ধ অফিসের সামনে গিয়ে ভিড় করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শৈলকুপা পৌরসভার সিটিকলেজ রোডের গ্রিস প্রবাসী আকবর হোসেনের বাড়ি ভাড়া নেয় এনজিও নামধারী একদল প্রতারক। কবিরপুর এলাকার সিটি কলেজ সড়কে একটি একতলা বাড়ির মূল ফটকের সামনে সাইনবোর্ড। তবে ফটকটি তালাবদ্ধ। সাইনবোর্ডটিতে লেখা আছে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সিরাক বাংলাদেশ, ক্ষুদ্র ঋণ দান ও কুটির শিল্প প্রকল্প’। অফিসের সামনে দুই একজন আসা-যাওয়া করছেন। তারা ঋণ পাওয়ার আশায় টাকা জামানত রেখে এখন ঘুরছেন।
স্থানীয়রা জানায়, মাসিক চার হাজার টাকায় বাড়িটি ভাড়া নেয় তারা। এক বছরের টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা ছিল। গত মাসের ২৫ সেপ্টেম্বর বাসার গেটে সিরাক বাংলাদেশ  নামে একটি সাইনবোর্ড লাগায় তারা। ১ অক্টোবর তাদের ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করার কথা ছিল।
জানা গেছে, এক সপ্তাহে তারা কয়েকশ মানুষের কাছ থেকে ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার নাম করে ৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে। এ  ঘটনায় শৈলকুপা থানায় এনজিও কর্মী নাজমুলকে প্রধান আসামি করে উপজেলার হড়রা গ্রামের প্রতারণার শিকার রুহুল আমিন মামলা দায়ের করেছেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা আবাইপুর গ্রামের সিটি কলেজ পাড়ার বাসিন্দা জাহানারা খাতুন। তার স্বামী রাজমিস্ত্রির কাজ করে। তিনিও সিরাক বাংলাদেশের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। মেয়ের জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋণের আশায় ১৫ হাজার ২৫০ টাকা দিয়েছেন ওই সংস্থার নাজমুল নামে এক কর্মীর কাছে। টাকা হারিয়ে এখন তিনি বাকরুদ্ধ।
উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের হাসি খাতুন জানান, একই গ্রামের লাভলী খাতুন প্রথমে তাকে সিরাক বাংলাদেশের কথা বলে। এরপর কেন্দ্রে গেলে এনজিও কর্মী তাকে ২৫০ টাকা ফি দিয়ে ভর্তি হতে বলে। তখন তিনি টাকা দিয়ে ভর্তি হন। এক দিন পরে তারা বলে, আপনি কত টাকা নিবেন ৫০ হাজার না ১ লাখ। তখন আমি বলি আপনারা আগে অন্যদের ঋণ দেন, তারপর আমরা নেব। পরের দিন সকালে আমাকে বলে, আপনার ছেলে আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। এ জন্য আপনাদের সদস্যই বাতিল করা হয়েছে। তখন আমাদের ভর্তির টাকা ফেরত দেন।
শ্রীমতি অঞ্জনা রাণী জানায়, তিনি প্রতিবেশীর কথা শুনে ওই এনজিওতে ২৫০ টাকা দিয়ে ভর্তি হন। এরপর অনেক কষ্টে ধার করে ৫০ হাজার টাকা ঋণের জন্য ৫ হাজার টাকা সঞ্চয় দেন। অক্টোবরের এক তারিখে তাদের ঋণ বিতরণের কথা ছিল। ঋণ নিতে গিয়ে দেখি অফিসে তালা ঝুলছে। টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে প্রতারক চক্র।
মোছা. রাবেয়া খাতুন জানায়, এনজিও কর্মীরা তাদের ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার প্রলোভন দেখায় । এই প্রলোভনে পড়ে তিনিসহ তার সমিতির পাঁচজন ১০ হাজার টাকা করে জমা দেন। কেউ কেউ পাঁচ হাজার টাকা করে জমা দেন। এনজিও কর্মীরা তাদের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে।
গোবিন্দপুর গ্রামের লাভলী খাতুন জানান, সিরাক বাংলাদেশ প্রথমে আমাদের বাড়িতে আসে কেন্দ্র করার জন্য। কারণ আমাদের বাড়িতে আরও কয়েকটি এনজিওর কেন্দ্র রয়েছে। আমার বাড়িতে দুটি এনজিওর কেন্দ্র থাকায় তাদেরও কেন্দ্র করার অনুমতি দেই। এ সময় তারা আমাকে বলে, আমাদের কিছু ভালো সদস্য দেন যাদের আমরা বিনা জামানতে ঋণ দেবো। তখন আমি আশপাশের নারীদের সঙ্গে কথা বলে সদস্য জোগাড় করি।
এরপর ওই এনজিও কর্মীরা বলেন, তাদের থেকে ঋণ নিতে হলে ১ লাখে ১০ হাজার টাকা করে জমা দিতে হবে। এরপর আমাদের বন্ধক রাখা জমিটি আবারও অন্যের কাছে বন্ধক দিয়ে ১০ হাজার টাকা জমা দেই। আমার দেখাদেখি অন্যরাও সঞ্চয়ের টাকা জমা দেন। এরপর ১ অক্টোবর তারা ঋণ বিতরণের কথা বলেন। আমরা নির্ধারিত দিনে টাকা নিতে গিয়ে দেখি অফিসে তালা ঝুলছে। আমরা  কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে আসি। পরের দিন আবার যাই। কিন্তু তাদের দেখা পায় না। তৃতীয় দিনে আমরা আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, এখানে যারা ছিল তারা চলে গেছে।
কবিরপুর এলাকার মনিরুল ইসলাম জানায়, সংস্থাটির কর্মকর্তারা এলাকায় বেশি পরিচিত নয়। মাত্র সাত দিন এখানে ছিল। তারা বেশির ভাগ সময় অফিসের মধ্যেই থেকেছেন। বাইরে শুধু অর্থ সংগ্রহের জন্য বেরিয়েছেন। নামজুল হোসেন নিজেকে সংস্থার প্রধান বলে পরিচয় দেন।
তিনি আরও জানান, প্রতিদিন দলে দলে গ্রাহক আসছেন। তারা ক্ষোভের কথা বলছেন। এখন পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে, কর্মকর্তারা সহস্রাধিক মানুষের কাছ থেকে দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের ব্যবহৃত মুঠোফোনগুলোও বন্ধ।
সিরাক বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত মুঠোফোনে জানিয়েছেন, তাদের সংস্থার ঝিনাইদহ জেলাতে কোনো শাখা নেই।এ ছাড়া তারা ঋণদান কর্মসূচি বাস্তবায়নও করেন না। তাদের সংস্থার নাম ব্যবহার করে একটি চক্র প্রতারণা করছে বলে ক্ষতিগ্রস্তদের মাধ্যমে তিনিও জানতে পেরেছেন।তিনি আরও জানান, প্রতারক চক্র এমআরএ নিবন্ধন সনদ নম্বর ব্যবহার করেছে সাইনবোর্ডে, যা তাদের নয়। তাদের সংস্থা এমআরএ নিবন্ধিত নয়। তিনি দাবি করেন, একটি প্রতারক চক্র তাদের সংস্থার নাম ও লোগো ব্যবহার করে এ প্রতারণা করেছেন। এ নিয়ে তারা মিরপুরের পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল সামী  বলেন, সিরাক বাংলাদেশ নামে একটি এনজিও শৈলকুপার বিভিন্ন গ্রামে ঋণ দেওয়ার নাম করে গরিব ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের কাছ থেকে জামানতের নামে টাকা নিয়েছেন। তারা ওই এলাকায় এক সপ্তাহের জন্য একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এলাকার লোকজন প্রতারিত হওয়ার পর অভিযোগ করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা সেখান থেকে তাদের অফিস গুটিয়ে নিয়ে চলে গেছে। পরে আমরা জানতে পারি, সিরাক বাংলাদেশ নামে যে এনজিওটির পরিচয় পাওয়া গেছে সেটি আসলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হিসেবে ময়মনসিংহ জেলায় নিবন্ধিত আছে। যার ঝিনাইদহ জেলার কোথাও কাজকর্ম করার কোনো বৈধতা নেই।
একটি অসাধু চক্র এই নাম ব্যবহার করে প্রতারণা করেছে। যদি কোনো এনজিও বা সংস্থার ঝিনাইদহে কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয় তাহলে অবশ্যই তাদের ঝিনাইদহ জেলা সমাজসেবা কার্যলয় থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হবে।