শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জিহাদী সংগঠনগুলোর মিল-অমিল কোথায়!

সংগৃহীত ছবি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জিহাদী সংগঠনগুলো।

ইয়েমেন-সহ কিছু দেশে জিহাদীরা তালেবানের বিজয়ে আতশবাজি পুড়িয়েছে, সোমালিয়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইসলামপস্থী সংগঠনগুলো অনলাইনে নানাভাবে এ ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে।

মাটি কামড়ে লড়াই করতে পারলে কীভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল সামরিক শক্তির বিরুদ্ধেও জয়ী হওয়া যায়, তারই এক দৃষ্টান্ত হিসেবে এই ঘটনাকে তারা দেখছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায় জিহাদী মতবাদের এক নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

সবচেয়ে বড় হুমকি আসতে পারে আল-কায়েদা এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর দিক থেকে, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি।

তালেবান কিছুকাল আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি করেছিল যে তারা এমন কোন উগ্রপন্থী সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, যারা পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালাতে চায়। কিন্তু আল-কায়েদার সাথে তালেবানের এখনও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।

অন্যদিকে আইএস হচ্ছে আল-কায়েদার প্রতিদ্বন্দ্বী। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই গোষ্ঠীটি এখন একটা চাপের মুখে থাকবে, এটা দেখানোর জন্য যে তারা এখনও প্রাসঙ্গিক।

ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রভিন্স (আইএস-কে অথবা আইএসকেপি) একটি আইএস সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী এবং তারা এ ক্ষেত্রে কোন সময় নষ্ট করেনি।

তালেবান কাবুলে ঢোকার কয়েকদিনের মধ্যেই গত ২৬শে অগাস্ট তারা কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে একটি আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়। এতে ১৩ জন মার্কিন সেনা সদস্যসহ অন্তত ১৭০ জন নিহত হয়।

তালেবান, ইসলামিক স্টেট, আর আল-কায়েদা একই আদর্শিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা তিনটি গোষ্ঠী, কিন্তু তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কার্যপদ্ধতিতে অনেক পার্থক্য আছে।

কিন্তু মৌলবাদী আদর্শগত মিল ছাড়া এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যগুলো কী?

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুফ্যান সেন্টারের গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ক বলছেন, আফগানিস্তানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হচ্ছে তালেবান।

তার মতে, আল-কায়েদা হচ্ছে এমন একটি জিহাদী গোষ্ঠী যারা জাতীয় সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়, এবং তারা তাদের নেটওয়ার্ক নতুন করে গড়ে তুলতে চাইছে। “ইসলামিক স্টেটও তাই। কিন্তু তাদের এখন ওঠার জন্য একটা কষ্টকর সংগ্রাম করতে হবে, কারণ তারা আল-কায়েদা এবং তালেবান – উভয়েরই চরম শত্রু।

আল-কায়েদা এবং তালেবানের উদ্ভব ঘটে প্রথমতঃ আফগানিস্তানে ১৯৮০-র দশকের সোভিয়েত অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং তার পরে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে আফগানিস্তানের ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়।

অন্যদিকে ইসলামিক স্টেটের জন্ম হয়েছিল এর অনেক বছর পরে, ইরাকে আল-কায়েদার (একিউআই) কিছু অবশিষ্টাংশের ভেতর থেকে। এই একিউআই হচ্ছে আল-কায়েদারই একটি স্থানীয় গোষ্ঠী – যার জন্ম ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন অভিযানের প্রতিক্রিয়ায়।

২০০৭ সালে যখন ইরাকে মার্কিন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়, তখন এই গোষ্ঠীটি বেশ কয়েক বছরের জন্য অগোচরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তারা আবার আত্মপ্রকাশ করে।

আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে। আল-কায়েদা কথাটির অর্থ ‘ভিত্তি’ – এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুসলমানদের সমরাস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা দেবার একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে এটি কাজ করতো।

ইসলামী বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে লোক এনে আল-কায়েদায় নিয়োগ করেছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

তালেবান – পশতু ভাষায় যার অর্থ ‘ছাত্র’, তাদের জন্ম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পরে।

এটি প্রধানত পশতুন একটি আন্দোলন – যার সূচনা পাকিস্তানের ওই অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোয়। মূলত সৌদি আরবের অর্থে পরিচালিত এ মাদ্রাসাগুলোতে সুন্নী ইসলামের একটি কট্টরপন্থী ধারা প্রচারিত হতো।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পশতুন এলাকাগুলোতে তালেবান অঙ্গীকার করেছিল যে তারা শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে এবং ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা ইসলামী শরিয়া আইনের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব কঠোর সংস্করণ কার্যকর করবে।

আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে খুব দ্রুতগতিতে তালেবান তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৬ সালে তারা প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানীর সরকারকে উৎখাত করে কাবুল দখল করে। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই তারা আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

অন্যদিকে, এ সময়ের মধ্যেই আল-কায়েদা একটি সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের নেটওয়ার্কের চাইতে অনেক বেশি কিছু হয়ে দাঁড়ায়। এটি পরিণত হয় বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা লালন করা একটি জিহাদী সংগঠনে।

কৃতজ্ঞতার নিদর্শন এবং অর্থায়নের প্রতিদান হিসেবে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাকে স্বাগত জানায় তালেবান।

ইরাকে একিউআই নামে আল-কায়েদার যে শাখা তৈরি হয়েছিল, তাদেরও ছিল বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ। তবে তাদের আদর্শ আল-কায়েদার মূলনীতিগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল।

২০০৬ সালে তারা ইরাকের অন্য আরও কয়েকটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সাথে মিলে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক’ নাম গ্রহণ করে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় তারা সুবিধাজনক অবস্থান কায়েম করার সময় ২০১১ সালে সংগঠনটি নতুন নাম গ্রহণ করে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যাণ্ড দ্য লেভান্ট’। তারা খেলাফত ঘোষণা করে এবং আল-কায়েদা থেকে দূরে সরে যায়।

ইসলামের ব্যাখ্যা এবং পার্থক্য

তালেবান, আল-কায়েদা এবং আইএস-এর একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো তাদের অনুসৃত সুন্নী ইসলামের একটি কট্টরপন্থী আদর্শ।

লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও ফেলো মিশেল গ্রোপ্পি বলছেন, এই গোষ্ঠীগুলোর সবাই বিশ্বাস করে যে ধর্মীয় জীবন থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে আলাদা করা যায় না।

“তারা বিশ্বাস করে যে ধর্মবিশ্বাসের নামে সহিংসতা যুক্তিসংগত, এবং এটি একটি কর্তব্যও বটে। যে যুদ্ধ করে না, সে একজন খারাপ মুসলিম”, বিবিসিকে বলেন মিশেল গ্রোপ্পি।

তিনি আরও বলেন, পবিত্র গ্রন্থের কিছু অংশের একটি “আক্ষরিক ব্যাখ্যা” – যা এক ভিন্ন ধরনের হুমকির প্রেক্ষাপটে লিখিত হয়েছিল – তা থেকে এ মতাদর্শের সৃষ্টি।

“বাইবেলের মতই কুরআনেও কিছু অংশ আছে, যা অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সাধারণভাবে মনে করেন, এসব সহিংস নীতি প্রযোজ্য ছিল ধর্ম প্রচারের শুরুর দিকে – যখন তা হুমকির মুখে ছিল। জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধও তখন অর্থবহ ছিল।”

তবে তালেবান, আল-কায়েদা এবং আইএস – তাদের সবাই এ ক্ষেত্রে অভিন্ন ধারণা পোষণ করলেও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী উগ্রপন্থার ক্ষেত্রে তাদের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তিনটি সংগঠনের মধ্যে এটাই বড় পার্থক্য।

এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?

তালেবানের লক্ষ্য আফগানিস্তানকে ঘিরেই। কিন্তু আল-কায়েদা এবং আইএসের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা আছে।

১৯৯০-এর দশকে গোষ্ঠীটি যখন প্রথমবার শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করে, তখন তাতে নারীদের জন্য কঠোর বিধিবিধান এবং কড়া শাস্তির ব্যবস্থা ছিল – যার মধ্যে ছিল প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, চাবুক মারা এবং হাত-পা কেটে দেয়া।

আফগানিস্তানে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে, এই ভয়েই তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।

ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল বাইম্যান বলছেন, আল-কায়েদা ও আইএসের শিক্ষা আরও বেশি উগ্র।

“তালেবান চায় আফগানিস্তানে মুসলিম অতীতের এক আদর্শায়িত ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, অন্য কোন দেশে পরিবর্তন আনার আগ্রহ তাদের নেই”- বিবিসিকে বলেন মি. বাইম্যান।

তার মতে, আল-কায়েদা এবং আইএস উভয়েরই যদিও বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ আছে এবং তারা একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তাদের মধ্যে অমিল আছে।

“আইএস চায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এখনই, কিন্তু আল-কায়েদা মনে করে সে সময় এখনও আসেনি। তারা মনে করে জিহাদী সম্প্রদায় এবং মুসলিম সমাজগুলো এখনও তৈরি নয়, এবং খেলাফত প্রতিষ্ঠা তাদের কাছে অগ্রাধিকার নয়।”

কার শত্রু কে?

তালেবান, আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট – এদের সবার চোখেই দূরের এবং কাছের শত্রু অভিন্ন।

এদের শত্রু তালিকার প্রথম কাতারে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব। এর পরের কাতারে আছে তাদের মিত্ররা, এবং সেই সব দেশগুলো যারা রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক রাখার নীতি গ্রহণ করেছে।

“শুরু থেকেই আইএস ছিল আল-কায়েদার চেয়ে বেশি সহিংস। পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়াও তারা জাতিগত সংগ্রাম শুরু করে অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধেও – যারা তাদের মতাদর্শের অনুসারী নয়,” বলেন ড্যানিয়েল বাইম্যান।

সুতরাং আইএস এবং আল-কায়েদার মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে – আল-কায়েদার প্রধান শত্রু যুক্তরাষ্ট্র হলেও আইএস কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরেও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

“যদিও শিয়াদেরকে আল-কায়েদাও ধর্মদ্রোহী মনে করে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস শিয়াদের হত্যা করাটা একটা চরমপন্থা – সম্পদের অপচয় এবং জিহাদী প্রকল্পের জন্য ক্ষতিকর,” বলেন মধ্যপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ।

মিশেল গ্রোপ্পি মনে করেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের ফিরে আসাটা এ বিভক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আইএস মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে তারা “বিশ্বাসঘাতকতা” করেছে।

তবে তালেবানের সাথে ইসলামিক স্টেটের কিছুটা সংযোগ রয়েছে তৃতীয় একটি সংগঠনের মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তানের আইএসের গোষ্ঠীটির সাথে তথাকথিত ‘হাক্কানি নেটওয়ার্কের’ জোরালো সম্পর্ক আছে, এবং এই নেটওয়ার্কটি আবার তালেবানের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

এসব গোষ্ঠী কীভাবে কাজ করে?

আল-কায়েদার প্রধান পরিচিতি ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত ভবনগুলোতে চালানো হামলার জন্য – যা ৯/১১ আক্রমণ নামে ডাকা হয়।

এ রকম উচ্চ-অভিঘাতের পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে আল-কায়েদা চায় সর্বত্র মুসলিম যোদ্ধাদের শক্তি বাড়াতে – এবং মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াতে।

তাদের প্রচারাভিযানের কেন্দ্রীয় ধারণাটি হচ্ছে, জিহাদ প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব, তবে স্থানীয় উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের চাইতে আল-কায়েদার লক্ষ্যকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ড্যানিয়েল বাইম্যান বলছেন, ইসলামিক স্টেটও একই কথা বলে কিন্তু “তাদের পথ অনেক বেশি সহিংস।”

“আইএসের চোখে সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে বিপ্লবী যুদ্ধেরই একটি অংশ। তাদের অধিকৃত জায়গাগুলোতে তারা গণ-মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ এবং ধর্ষণ চালিয়েছে। তারা ভীতির সঞ্চার করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাদের অনুগত বানাতে চেয়েছে। আল-কায়েদার পন্থা এক্ষেত্রে যেন কিছুটা নমনীয় – যদি আমি এ শব্দটা ব্যবহার করতে পারি।”

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আইএস ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অংশে তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করলেও পরে পশ্চিমা, কুর্দি ও রুশ-সমর্থিত সিরিয়ান বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হয় এবং খেলাফত বিলুপ্ত হয়।

কিন্তু তারা এখন একটি গোপন নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে এবং এখনও একটি হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে।

আফগান-ভিত্তিক আইএস-কে ২৬শে অগাস্ট কাবুল বিমানবন্দরে যে আক্রমণ চালায়, তাতে ১৭০ জন নিহত হয়। এছাড়া, তারা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে।

তালেবান অন্যদিকে আফগান সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বড় শহরগুলো দখল করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাবুল জয় করেছে। তালেবানের বিরুদ্ধে আফগান সরকারি সৈন্যদের হত্যা, কঠোর শাস্তি, নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে।

তবে গ্রোপ্পি বলছেন, তারা অবশ্য বিশেষত গ্রামের স্থানীয় লোকদের কাছে গিয়ে এটা বোঝানোরও চেষ্টা করেছে যে আফগানিস্তানে দুর্নীতির মত যেসব সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান একমাত্র তারাই করতে পারে।

সদস্য সংগ্রহ

তালেবান, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট – এই তিনটি গোষ্ঠীই স্থানীয় জনগণের ভেতর থেকে তাদের লক্ষ্য অর্জনের যুদ্ধের জন্য লোক সংগ্রহ করতে পেরেছে।

“জিহাদ ধর্মকে রক্ষা করবে এবং তাকে বিশুদ্ধ করবে” – এ অঙ্গীকার করেই তারা এটা করতে পেরেছে।

বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে আল-কায়েদা এবং আইএস মধ্যপ্রাচ্যের সীমানার বাইরে থেকেও লোক নিয়োগ করেছে। তবে মিশেল গ্রোপ্পি বলছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইসলামিক স্টেটই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে।

বাইম্যানও এ ব্যাপারে একমত। তার কথায়, “সামাজিক মাধ্যমে আইএস যেভাবে কাজ করেছে তা চমকপ্রদ, এবং তারা পশ্চিমাদেশগুলোতে বাস করা লোকদের অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে তাদের সাথে যুক্ত করতে পেরেছে।”

“এদের অনেকে সিরিয়া বা ইরাক যেতে পারেনি, অনেকে সংগঠনটির সাথে খুব সামান্যই যোগাযোগ করতে পেরেছে বা একেবারেই পারেনি, তা সত্বেও তারা তাদের নিজ নিজ দেশে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে।”

এ রকম আক্রমণের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৫ সালে প্যারিসে সংঘটিত হামলা। এতে যুক্ত আইএসের জঙ্গিদের কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্রেও ছিল। প্যারিসে তাদের চালানো হামলায় নিহত হয় ১৩০ জন – যা ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে ফ্রান্সে শান্তিকালীন সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণ।

সূত্র: বিবিসি

ইসরায়েল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আক্রমণ’ও চালায়,তার জবাব হবে কঠোর-ইরানের প্রেসিডেন্ট

জিহাদী সংগঠনগুলোর মিল-অমিল কোথায়!

প্রকাশের সময় : ০৪:২১:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের জিহাদী সংগঠনগুলো।

ইয়েমেন-সহ কিছু দেশে জিহাদীরা তালেবানের বিজয়ে আতশবাজি পুড়িয়েছে, সোমালিয়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ইসলামপস্থী সংগঠনগুলো অনলাইনে নানাভাবে এ ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছে।

মাটি কামড়ে লড়াই করতে পারলে কীভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল সামরিক শক্তির বিরুদ্ধেও জয়ী হওয়া যায়, তারই এক দৃষ্টান্ত হিসেবে এই ঘটনাকে তারা দেখছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের জয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায় জিহাদী মতবাদের এক নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।

সবচেয়ে বড় হুমকি আসতে পারে আল-কায়েদা এবং তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর সাথে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর দিক থেকে, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু একেবারে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি।

তালেবান কিছুকাল আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তি করেছিল যে তারা এমন কোন উগ্রপন্থী সংগঠনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, যারা পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ চালাতে চায়। কিন্তু আল-কায়েদার সাথে তালেবানের এখনও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।

অন্যদিকে আইএস হচ্ছে আল-কায়েদার প্রতিদ্বন্দ্বী। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই গোষ্ঠীটি এখন একটা চাপের মুখে থাকবে, এটা দেখানোর জন্য যে তারা এখনও প্রাসঙ্গিক।

ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রভিন্স (আইএস-কে অথবা আইএসকেপি) একটি আইএস সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী এবং তারা এ ক্ষেত্রে কোন সময় নষ্ট করেনি।

তালেবান কাবুলে ঢোকার কয়েকদিনের মধ্যেই গত ২৬শে অগাস্ট তারা কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে একটি আত্মঘাতী আক্রমণ চালায়। এতে ১৩ জন মার্কিন সেনা সদস্যসহ অন্তত ১৭০ জন নিহত হয়।

তালেবান, ইসলামিক স্টেট, আর আল-কায়েদা একই আদর্শিক ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা তিনটি গোষ্ঠী, কিন্তু তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং কার্যপদ্ধতিতে অনেক পার্থক্য আছে।

কিন্তু মৌলবাদী আদর্শগত মিল ছাড়া এই তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যগুলো কী?

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সুফ্যান সেন্টারের গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ক বলছেন, আফগানিস্তানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হচ্ছে তালেবান।

তার মতে, আল-কায়েদা হচ্ছে এমন একটি জিহাদী গোষ্ঠী যারা জাতীয় সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নয়, এবং তারা তাদের নেটওয়ার্ক নতুন করে গড়ে তুলতে চাইছে। “ইসলামিক স্টেটও তাই। কিন্তু তাদের এখন ওঠার জন্য একটা কষ্টকর সংগ্রাম করতে হবে, কারণ তারা আল-কায়েদা এবং তালেবান – উভয়েরই চরম শত্রু।

আল-কায়েদা এবং তালেবানের উদ্ভব ঘটে প্রথমতঃ আফগানিস্তানে ১৯৮০-র দশকের সোভিয়েত অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং তার পরে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে আফগানিস্তানের ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্বের সময়।

অন্যদিকে ইসলামিক স্টেটের জন্ম হয়েছিল এর অনেক বছর পরে, ইরাকে আল-কায়েদার (একিউআই) কিছু অবশিষ্টাংশের ভেতর থেকে। এই একিউআই হচ্ছে আল-কায়েদারই একটি স্থানীয় গোষ্ঠী – যার জন্ম ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন অভিযানের প্রতিক্রিয়ায়।

২০০৭ সালে যখন ইরাকে মার্কিন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়, তখন এই গোষ্ঠীটি বেশ কয়েক বছরের জন্য অগোচরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে তারা আবার আত্মপ্রকাশ করে।

আল-কায়েদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিকে। আল-কায়েদা কথাটির অর্থ ‘ভিত্তি’ – এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত মুসলমানদের সমরাস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা দেবার একটি নেটওয়ার্ক হিসেবে এটি কাজ করতো।

ইসলামী বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে লোক এনে আল-কায়েদায় নিয়োগ করেছিলেন ওসামা বিন লাদেন।

তালেবান – পশতু ভাষায় যার অর্থ ‘ছাত্র’, তাদের জন্ম পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সৈন্য প্রত্যাহারের পরে।

এটি প্রধানত পশতুন একটি আন্দোলন – যার সূচনা পাকিস্তানের ওই অঞ্চলের মাদ্রাসাগুলোয়। মূলত সৌদি আরবের অর্থে পরিচালিত এ মাদ্রাসাগুলোতে সুন্নী ইসলামের একটি কট্টরপন্থী ধারা প্রচারিত হতো।

পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পশতুন এলাকাগুলোতে তালেবান অঙ্গীকার করেছিল যে তারা শান্তি ও নিরাপত্তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে এবং ক্ষমতায় আসতে পারলে তারা ইসলামী শরিয়া আইনের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব কঠোর সংস্করণ কার্যকর করবে।

আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে খুব দ্রুতগতিতে তালেবান তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৬ সালে তারা প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানীর সরকারকে উৎখাত করে কাবুল দখল করে। ১৯৯৮ সালের মধ্যেই তারা আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়।

অন্যদিকে, এ সময়ের মধ্যেই আল-কায়েদা একটি সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের নেটওয়ার্কের চাইতে অনেক বেশি কিছু হয়ে দাঁড়ায়। এটি পরিণত হয় বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা লালন করা একটি জিহাদী সংগঠনে।

কৃতজ্ঞতার নিদর্শন এবং অর্থায়নের প্রতিদান হিসেবে আফগানিস্তানে আল-কায়েদাকে স্বাগত জানায় তালেবান।

ইরাকে একিউআই নামে আল-কায়েদার যে শাখা তৈরি হয়েছিল, তাদেরও ছিল বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ। তবে তাদের আদর্শ আল-কায়েদার মূলনীতিগুলোর চেয়ে আলাদা ছিল।

২০০৬ সালে তারা ইরাকের অন্য আরও কয়েকটি উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর সাথে মিলে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক’ নাম গ্রহণ করে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় তারা সুবিধাজনক অবস্থান কায়েম করার সময় ২০১১ সালে সংগঠনটি নতুন নাম গ্রহণ করে ‘ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যাণ্ড দ্য লেভান্ট’। তারা খেলাফত ঘোষণা করে এবং আল-কায়েদা থেকে দূরে সরে যায়।

ইসলামের ব্যাখ্যা এবং পার্থক্য

তালেবান, আল-কায়েদা এবং আইএস-এর একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো তাদের অনুসৃত সুন্নী ইসলামের একটি কট্টরপন্থী আদর্শ।

লন্ডনের কিংস কলেজের শিক্ষক ও ফেলো মিশেল গ্রোপ্পি বলছেন, এই গোষ্ঠীগুলোর সবাই বিশ্বাস করে যে ধর্মীয় জীবন থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে আলাদা করা যায় না।

“তারা বিশ্বাস করে যে ধর্মবিশ্বাসের নামে সহিংসতা যুক্তিসংগত, এবং এটি একটি কর্তব্যও বটে। যে যুদ্ধ করে না, সে একজন খারাপ মুসলিম”, বিবিসিকে বলেন মিশেল গ্রোপ্পি।

তিনি আরও বলেন, পবিত্র গ্রন্থের কিছু অংশের একটি “আক্ষরিক ব্যাখ্যা” – যা এক ভিন্ন ধরনের হুমকির প্রেক্ষাপটে লিখিত হয়েছিল – তা থেকে এ মতাদর্শের সৃষ্টি।

“বাইবেলের মতই কুরআনেও কিছু অংশ আছে, যা অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু মুসলিমদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সাধারণভাবে মনে করেন, এসব সহিংস নীতি প্রযোজ্য ছিল ধর্ম প্রচারের শুরুর দিকে – যখন তা হুমকির মুখে ছিল। জিহাদ বা পবিত্র যুদ্ধও তখন অর্থবহ ছিল।”

তবে তালেবান, আল-কায়েদা এবং আইএস – তাদের সবাই এ ক্ষেত্রে অভিন্ন ধারণা পোষণ করলেও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুযায়ী উগ্রপন্থার ক্ষেত্রে তাদের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, তিনটি সংগঠনের মধ্যে এটাই বড় পার্থক্য।

এদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কী?

তালেবানের লক্ষ্য আফগানিস্তানকে ঘিরেই। কিন্তু আল-কায়েদা এবং আইএসের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা আছে।

১৯৯০-এর দশকে গোষ্ঠীটি যখন প্রথমবার শরীয়া আইন বাস্তবায়ন করে, তখন তাতে নারীদের জন্য কঠোর বিধিবিধান এবং কড়া শাস্তির ব্যবস্থা ছিল – যার মধ্যে ছিল প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা, চাবুক মারা এবং হাত-পা কেটে দেয়া।

আফগানিস্তানে সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে, এই ভয়েই তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর দলে দলে লোক দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে।

ওয়াশিংটনের জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল বাইম্যান বলছেন, আল-কায়েদা ও আইএসের শিক্ষা আরও বেশি উগ্র।

“তালেবান চায় আফগানিস্তানে মুসলিম অতীতের এক আদর্শায়িত ধারণাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে, অন্য কোন দেশে পরিবর্তন আনার আগ্রহ তাদের নেই”- বিবিসিকে বলেন মি. বাইম্যান।

তার মতে, আল-কায়েদা এবং আইএস উভয়েরই যদিও বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ আছে এবং তারা একটি খিলাফত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে তাদের মধ্যে অমিল আছে।

“আইএস চায় খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হবে এখনই, কিন্তু আল-কায়েদা মনে করে সে সময় এখনও আসেনি। তারা মনে করে জিহাদী সম্প্রদায় এবং মুসলিম সমাজগুলো এখনও তৈরি নয়, এবং খেলাফত প্রতিষ্ঠা তাদের কাছে অগ্রাধিকার নয়।”

কার শত্রু কে?

তালেবান, আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট – এদের সবার চোখেই দূরের এবং কাছের শত্রু অভিন্ন।

এদের শত্রু তালিকার প্রথম কাতারে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্ব। এর পরের কাতারে আছে তাদের মিত্ররা, এবং সেই সব দেশগুলো যারা রাষ্ট্র ও ধর্মকে পৃথক রাখার নীতি গ্রহণ করেছে।

“শুরু থেকেই আইএস ছিল আল-কায়েদার চেয়ে বেশি সহিংস। পশ্চিমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছাড়াও তারা জাতিগত সংগ্রাম শুরু করে অন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধেও – যারা তাদের মতাদর্শের অনুসারী নয়,” বলেন ড্যানিয়েল বাইম্যান।

সুতরাং আইএস এবং আল-কায়েদার মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে – আল-কায়েদার প্রধান শত্রু যুক্তরাষ্ট্র হলেও আইএস কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সম্প্রদায় এবং অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপরেও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে।

“যদিও শিয়াদেরকে আল-কায়েদাও ধর্মদ্রোহী মনে করে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস শিয়াদের হত্যা করাটা একটা চরমপন্থা – সম্পদের অপচয় এবং জিহাদী প্রকল্পের জন্য ক্ষতিকর,” বলেন মধ্যপ্রাচ্য ও সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ।

মিশেল গ্রোপ্পি মনে করেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের ফিরে আসাটা এ বিভক্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ আইএস মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সেনা প্রত্যাহারের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে তারা “বিশ্বাসঘাতকতা” করেছে।

তবে তালেবানের সাথে ইসলামিক স্টেটের কিছুটা সংযোগ রয়েছে তৃতীয় একটি সংগঠনের মাধ্যমে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আফগানিস্তানের আইএসের গোষ্ঠীটির সাথে তথাকথিত ‘হাক্কানি নেটওয়ার্কের’ জোরালো সম্পর্ক আছে, এবং এই নেটওয়ার্কটি আবার তালেবানের সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

এসব গোষ্ঠী কীভাবে কাজ করে?

আল-কায়েদার প্রধান পরিচিতি ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার নামে পরিচিত ভবনগুলোতে চালানো হামলার জন্য – যা ৯/১১ আক্রমণ নামে ডাকা হয়।

এ রকম উচ্চ-অভিঘাতের পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে আল-কায়েদা চায় সর্বত্র মুসলিম যোদ্ধাদের শক্তি বাড়াতে – এবং মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে তাড়াতে।

তাদের প্রচারাভিযানের কেন্দ্রীয় ধারণাটি হচ্ছে, জিহাদ প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব, তবে স্থানীয় উদ্দেশ্য-লক্ষ্যের চাইতে আল-কায়েদার লক্ষ্যকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে।

ড্যানিয়েল বাইম্যান বলছেন, ইসলামিক স্টেটও একই কথা বলে কিন্তু “তাদের পথ অনেক বেশি সহিংস।”

“আইএসের চোখে সন্ত্রাসবাদ হচ্ছে বিপ্লবী যুদ্ধেরই একটি অংশ। তাদের অধিকৃত জায়গাগুলোতে তারা গণ-মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ এবং ধর্ষণ চালিয়েছে। তারা ভীতির সঞ্চার করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তাদের অনুগত বানাতে চেয়েছে। আল-কায়েদার পন্থা এক্ষেত্রে যেন কিছুটা নমনীয় – যদি আমি এ শব্দটা ব্যবহার করতে পারি।”

২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আইএস ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অংশে তাদের খেলাফত প্রতিষ্ঠা করলেও পরে পশ্চিমা, কুর্দি ও রুশ-সমর্থিত সিরিয়ান বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হয় এবং খেলাফত বিলুপ্ত হয়।

কিন্তু তারা এখন একটি গোপন নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে এবং এখনও একটি হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে।

আফগান-ভিত্তিক আইএস-কে ২৬শে অগাস্ট কাবুল বিমানবন্দরে যে আক্রমণ চালায়, তাতে ১৭০ জন নিহত হয়। এছাড়া, তারা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ওপরও আক্রমণ চালাচ্ছে।

তালেবান অন্যদিকে আফগান সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে বড় শহরগুলো দখল করেছে এবং শেষ পর্যন্ত কাবুল জয় করেছে। তালেবানের বিরুদ্ধে আফগান সরকারি সৈন্যদের হত্যা, কঠোর শাস্তি, নারীদের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে।

তবে গ্রোপ্পি বলছেন, তারা অবশ্য বিশেষত গ্রামের স্থানীয় লোকদের কাছে গিয়ে এটা বোঝানোরও চেষ্টা করেছে যে আফগানিস্তানে দুর্নীতির মত যেসব সমস্যা রয়েছে, তার সমাধান একমাত্র তারাই করতে পারে।

সদস্য সংগ্রহ

তালেবান, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট – এই তিনটি গোষ্ঠীই স্থানীয় জনগণের ভেতর থেকে তাদের লক্ষ্য অর্জনের যুদ্ধের জন্য লোক সংগ্রহ করতে পেরেছে।

“জিহাদ ধর্মকে রক্ষা করবে এবং তাকে বিশুদ্ধ করবে” – এ অঙ্গীকার করেই তারা এটা করতে পেরেছে।

বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে আল-কায়েদা এবং আইএস মধ্যপ্রাচ্যের সীমানার বাইরে থেকেও লোক নিয়োগ করেছে। তবে মিশেল গ্রোপ্পি বলছেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইসলামিক স্টেটই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে।

বাইম্যানও এ ব্যাপারে একমত। তার কথায়, “সামাজিক মাধ্যমে আইএস যেভাবে কাজ করেছে তা চমকপ্রদ, এবং তারা পশ্চিমাদেশগুলোতে বাস করা লোকদের অপেক্ষাকৃত ভালোভাবে তাদের সাথে যুক্ত করতে পেরেছে।”

“এদের অনেকে সিরিয়া বা ইরাক যেতে পারেনি, অনেকে সংগঠনটির সাথে খুব সামান্যই যোগাযোগ করতে পেরেছে বা একেবারেই পারেনি, তা সত্বেও তারা তাদের নিজ নিজ দেশে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছে।”

এ রকম আক্রমণের মধ্যে অন্যতম ছিল ২০১৫ সালে প্যারিসে সংঘটিত হামলা। এতে যুক্ত আইএসের জঙ্গিদের কেউ কেউ যুদ্ধক্ষেত্রেও ছিল। প্যারিসে তাদের চালানো হামলায় নিহত হয় ১৩০ জন – যা ছিল গত কয়েক দশকের মধ্যে ফ্রান্সে শান্তিকালীন সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে নৃশংস আক্রমণ।

সূত্র: বিবিসি