মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পতন

স্টাফ রিপোর্টার ##

ভার্জিলিও পিনেরার জন্ম ১৯১২ সালের ৪ আগস্ট কিউবার কারডেনাসে। তিনি একাধারে লেখক, নাট্যকার, কবি, ছোট গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক ছিলেন;  ১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাভানায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি। পরবর্তীতে তার লিখে যাওয়া ৪৩ টি গল্প নিয়ে ‘কোল্ড টেলস্’ নামের বইটি প্রকাশিত হয়। ‘পতন’ শিরোনামের গল্পটিও তাঁর ‘কোল্ড টেলস’ গ্রন্থের অন্তর্গত। গল্পটি ভাষান্তর করেছেন-মাইশা তাবাসসুম।

আমরা দু’জন মিলে প্রথমে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়টি মাপলাম। কেন মাপলাম জানি না। তবে চূড়ায় কোনো বীজ পোঁতার জন্য, বা পর্বত জয় করার জন্য নয়। কিছুক্ষণ পরেই আবার নামতে শুরু করলাম। আমি এবং আমার সঙ্গী, কোমরের দিকটায় একই দড়ি দিয়ে বাঁধা, সে উপরে আমি নিচে। আনুমানিক ৯৮ ফুট নামার পর আমার সঙ্গীর বুটের নিচ থেকে একটা পাথর ফসকে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ডিগবাজি খেয়ে তার অবস্থান থেকে ছিটকে পড়লো। তখনই দড়িটা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে আমাকে আঘাত করলো, যেন কোন ধারে আছাড় না খাই, তাই আমি এক ঝলকে মোচড় দিয়ে উল্টো দিকে (পাহাড়ের দিকে পিঠ করে) ঘুরে গেলাম।

আর এদিকে সেও ঠিক আমার দিকেই পড়তে লাগলো। তার এরকম সিদ্ধান্ত মোটেও হাস্যকর বা অদ্ভুত ছিল না, সে শুধু পরিস্থিতির সাড়া দিচ্ছিল। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই সে আমাকে অতিক্রম করে উল্কার মতো নেমে গেল, আর যেহেতু আমিও একই দড়িতে বাঁধা, সেহেতু আমাকেও নেমে যেতে হলো। ভৌত নীতি অনুযায়ী, সে প্রথমে যতটা দ্রুত পড়ছিল কিছুক্ষণ পর সেই বেগ বাতাসের ধাক্কায় কমে আসলো, যার ফলে আমরা মুখোমুখি চলে আসলাম। দু’জনের কেউই কোনো কথা বললাম না; কিন্তু দু’জনই জানতাম, আমাদের এই উদ্দাম পতন অনিবার্য। একটা অযাচিত অনির্দিষ্টকাল পর থেকে আমরা দু’জন একই সঙ্গে পড়ে যেতে থাকলাম। আমার একমাত্র উদ্বেগ ছিল, এই পতনের ভয়াবহতা থেকে আমার চোখ দুটিকে রক্ষা করা, তাই আমি সর্বাত্মকভাবে সেই চেষ্টা করতে লাগলাম।

অপরদিকে আমার সঙ্গীর চিন্তা তার দাড়ি নিয়ে, সেই গথিক গ্লাসের মতো চকচকে ধূসর দাড়িতে যেন সামান্য ময়লাও না লাগে। সুতরাং সর্বাধিক দৃঢ়তার সঙ্গে, আমি আমার হাত দিয়ে ঢাকলাম তার দাড়ি, আর সে ঢাকলো আমার চোখ। আমাদের পতনের গতি ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। হঠাৎ তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, একটা ধারালো পাথরে তার মাথা সম্পূর্ণ থেঁতলে গেল, আর তখনই টের পেলাম যে, আমার ধড় থেকে আমার পা দুটি আলাদা হয়ে গেছে। একে অপরের চোখ ও দাড়ি রক্ষা করতে করতেই আমি খেয়াল করলাম যে, প্রতি ৫ ফুট পর পর আমাদের এক একটি অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

যেমন, এরকম ৫ ফুটের ৫টি ব্যবধানের মধ্যেই, আমি হারালাম যথাক্রমে, বুকের পাঁজরের হাড়, মেরুদণ্ড, বাম চোখের ভ্রু, বাম কান ও ঘাড়ের শিরা; আর সে হারালো যথাক্রমে, বাম কান, ডান কনুই, একটি পা, অণ্ডকোষ ও নাক। মাটিতে পড়ার ঠিক এক হাজার ফুট উপরে আমার বাকি ছিল, দুই হাত ও দুই চোখ এবং তার, দুই হাত ও দাড়ি। দু’জনেরই মনে এক ভয়, এখন যদি কোন পাথর এই হাতে আঘাত করে? পড়তে পড়তে যখন ঠিক দশ ফুট উপরে, তখন পিলারের আঘাতে আমার সঙ্গীর হাত দুটি গেল, আর আমার চোখ দুটি এতিম হয়ে গেল।

জনপ্রিয়

পতন

প্রকাশের সময় : ০৫:৩৮:১৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ জুন ২০২১

স্টাফ রিপোর্টার ##

ভার্জিলিও পিনেরার জন্ম ১৯১২ সালের ৪ আগস্ট কিউবার কারডেনাসে। তিনি একাধারে লেখক, নাট্যকার, কবি, ছোট গল্পকার এবং প্রাবন্ধিক ছিলেন;  ১৯৭৯ সালের ১৮ অক্টোবর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হাভানায় মৃত্যু বরণ করেন তিনি। পরবর্তীতে তার লিখে যাওয়া ৪৩ টি গল্প নিয়ে ‘কোল্ড টেলস্’ নামের বইটি প্রকাশিত হয়। ‘পতন’ শিরোনামের গল্পটিও তাঁর ‘কোল্ড টেলস’ গ্রন্থের অন্তর্গত। গল্পটি ভাষান্তর করেছেন-মাইশা তাবাসসুম।

আমরা দু’জন মিলে প্রথমে তিন হাজার ফুট উঁচু পাহাড়টি মাপলাম। কেন মাপলাম জানি না। তবে চূড়ায় কোনো বীজ পোঁতার জন্য, বা পর্বত জয় করার জন্য নয়। কিছুক্ষণ পরেই আবার নামতে শুরু করলাম। আমি এবং আমার সঙ্গী, কোমরের দিকটায় একই দড়ি দিয়ে বাঁধা, সে উপরে আমি নিচে। আনুমানিক ৯৮ ফুট নামার পর আমার সঙ্গীর বুটের নিচ থেকে একটা পাথর ফসকে গেল, এবং সঙ্গে সঙ্গে সে একটা ডিগবাজি খেয়ে তার অবস্থান থেকে ছিটকে পড়লো। তখনই দড়িটা প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে আমাকে আঘাত করলো, যেন কোন ধারে আছাড় না খাই, তাই আমি এক ঝলকে মোচড় দিয়ে উল্টো দিকে (পাহাড়ের দিকে পিঠ করে) ঘুরে গেলাম।

আর এদিকে সেও ঠিক আমার দিকেই পড়তে লাগলো। তার এরকম সিদ্ধান্ত মোটেও হাস্যকর বা অদ্ভুত ছিল না, সে শুধু পরিস্থিতির সাড়া দিচ্ছিল। কয়েক মুহূর্তের মাঝেই সে আমাকে অতিক্রম করে উল্কার মতো নেমে গেল, আর যেহেতু আমিও একই দড়িতে বাঁধা, সেহেতু আমাকেও নেমে যেতে হলো। ভৌত নীতি অনুযায়ী, সে প্রথমে যতটা দ্রুত পড়ছিল কিছুক্ষণ পর সেই বেগ বাতাসের ধাক্কায় কমে আসলো, যার ফলে আমরা মুখোমুখি চলে আসলাম। দু’জনের কেউই কোনো কথা বললাম না; কিন্তু দু’জনই জানতাম, আমাদের এই উদ্দাম পতন অনিবার্য। একটা অযাচিত অনির্দিষ্টকাল পর থেকে আমরা দু’জন একই সঙ্গে পড়ে যেতে থাকলাম। আমার একমাত্র উদ্বেগ ছিল, এই পতনের ভয়াবহতা থেকে আমার চোখ দুটিকে রক্ষা করা, তাই আমি সর্বাত্মকভাবে সেই চেষ্টা করতে লাগলাম।

অপরদিকে আমার সঙ্গীর চিন্তা তার দাড়ি নিয়ে, সেই গথিক গ্লাসের মতো চকচকে ধূসর দাড়িতে যেন সামান্য ময়লাও না লাগে। সুতরাং সর্বাধিক দৃঢ়তার সঙ্গে, আমি আমার হাত দিয়ে ঢাকলাম তার দাড়ি, আর সে ঢাকলো আমার চোখ। আমাদের পতনের গতি ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। হঠাৎ তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম, একটা ধারালো পাথরে তার মাথা সম্পূর্ণ থেঁতলে গেল, আর তখনই টের পেলাম যে, আমার ধড় থেকে আমার পা দুটি আলাদা হয়ে গেছে। একে অপরের চোখ ও দাড়ি রক্ষা করতে করতেই আমি খেয়াল করলাম যে, প্রতি ৫ ফুট পর পর আমাদের এক একটি অঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

যেমন, এরকম ৫ ফুটের ৫টি ব্যবধানের মধ্যেই, আমি হারালাম যথাক্রমে, বুকের পাঁজরের হাড়, মেরুদণ্ড, বাম চোখের ভ্রু, বাম কান ও ঘাড়ের শিরা; আর সে হারালো যথাক্রমে, বাম কান, ডান কনুই, একটি পা, অণ্ডকোষ ও নাক। মাটিতে পড়ার ঠিক এক হাজার ফুট উপরে আমার বাকি ছিল, দুই হাত ও দুই চোখ এবং তার, দুই হাত ও দাড়ি। দু’জনেরই মনে এক ভয়, এখন যদি কোন পাথর এই হাতে আঘাত করে? পড়তে পড়তে যখন ঠিক দশ ফুট উপরে, তখন পিলারের আঘাতে আমার সঙ্গীর হাত দুটি গেল, আর আমার চোখ দুটি এতিম হয়ে গেল।