সোমবার সন্ধ্যায় বরগুনা পৌর শহরের নয়াকাটা মাইঠা এলাকায় নিজস্ব বাসভবনে এসব কথা বলেন বরগুনার চাঞ্চল্যকর রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির মা মিলি আক্তার।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমার মেয়েকে আসামি শনাক্ত করার কথা বলেনিয়ে বরগুনার পুলিশ লাইনসের একটি কক্ষে আটকে রেখে ১০-১২ ঘণ্টা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। রোববার আমরা মিন্নির সাথে জেলা কারাগারে দেখা করতে গেলে মিন্নি আমাদের কাছে সেই ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার মেয়েকে তিন দিন পুলিশ না খাইয়ে রেখেছে। একটু পানি খেতে চাইলেও তাকে দেওয়া হয়নি। একপর্যায়ে ট্যাবলেট মিশিয়ে তাকে পানি খেতে দেওয়া হয়। আমার মেয়েকে দিয়ে পুলিশের লিখি দেওয়া জবানবন্দি মুখস্থ করানোর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখে। বারবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেও পুলিশের মন গলেনি। আবার দাঁড় করিয়ে জবানবন্দি মুখস্থ করায়। এ সময় জবানবন্দি না দিতে চাইলে মা-বাবা ও চাচাকেও ধরে এনে নির্যাতনের হুমকি দেয় পুলিশের এএসআই রিতা নামের এক নারী কর্মকর্তা। এ সময় তিনি তাকে চর থাপ্পড়সহ লাথি মারেন বলেও জানায় মিন্নি।
মিন্নির মা বলেন, আমার মেয়ে জবানবন্দি দিতে অস্বীকৃতি জানালে তার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে নয়ন বন্ডের মতো গুলি করে মেরে ফেলা হবে বলে হুমকি দেয় তারা। রিফাত ফরাজী ও রিশান ফরাজীকে আমার মেয়ের সামনে এনে বলতে বলে, বল তোদের সঙ্গে মিন্নিও জড়িত ছিল। প্রথম দিকে না বললেও পুলিশের জোরাজুরি ও শারীরিক নির্যাতনে একপর্যায়ে পুলিশের শিখিয়ে দেওয়া কথা মতো রিফাত ও রিশান বলতে বাধ্য হয় মিন্নি এই ঘটনায় জড়িত ছিল।
মিন্নির মা মেয়ের শারীরিক অবস্থা নিয়ে বলেন, আমার মেয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ড অসুস্থ। সারা রাত ঘুমাতে পারে না। জেল খানার চার দেয়ালের মধ্যে আমার মেয়ে দিন দিন মানসিকভাবে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তার স্বামী হত্যার দৃশ্য ও রিমান্ডে নিয়ে যে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়েছে সেই সব স্মৃতি এখন তার চোখে ভাসে।
মিলি আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা দু দণ্ড কোথাও শান্তিতে যেতে পারি না। যেখানেই যাই সেখানেই পুলিশের সদস্যরা আমাদের পিছু পিছু যায়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় নানা অজুহাতে আমাদের বাসায় এসে মিন্নির বাবার খোঁজ করে। বাসায় না থাকলেই জানতে চায় কোথায় আছে? কিভাবে আছে? মিন্নির বাবা কয়েক দিন আগে তালতলি গিয়েছিল সেখানে গিয়ে তাকে খোঁজ করা হয়।
মিন্নির মা বলেন, পুলিশ আমার মেয়েকে বলতে বলে তুমি আদালতে বলবা আমার স্বামীতো ভালো না তাই হালকা পাতলা মাইর দেওয়ার কথা বলেছি। তাহলে তোমার শাস্তি কম হবে। পুলিশের শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী মিন্নি আদালতে এ রকম স্বীকারোক্তি প্রদান করে।
মিন্নির মা মিলি আক্তার বলেন, রবিবার আমার মেয়ের সাথে দেখা করার সময় সেখানে জেলখানা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ। এ সময় মিন্নি তার ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছে সে বিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানায়।
এর আগে বিভিন্ন সময় মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর জেলখানায় মিন্নির সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন তার মেয়ের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে জোরজবরদস্তি করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। সেই সঙ্গে তিনি তার মেয়ের উন্নত চিকিৎসার দাবি করেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমি কারাগারে বন্দীদের খোঁজ খবর নিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আলাদা করে মিন্নির সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ হয়নি। সকল আসামিরা সেখানে উপস্থিত ছিল আমি সবার সঙ্গেই কথা বলেছি।
মিন্নির মা দাবি করছেন আপনার সঙ্গে মিন্নির সাক্ষাৎ হয়েছে সে আপনাকে তার ওপর নির্যাতন হয়েছে বলে জানিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে জেলা প্রশাসক বলেন, আমার সঙ্গে তার আলাদা করে কোন সাক্ষাৎ হয়নি এবং আমার কাছে সে কোন ধরনেরে শারীরিক কিংবা মানসিক নির্যাতনের কথাও জানায়নি।
এ বিষয়ে বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হুমায়ন কবির ও বরগুনার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউই ফোন রিসিভ করেননি।
রিফাত হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত মিন্নিসহ ১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা সবাই ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। মামলার এজাহারভুক্ত ১২ আসামির মধ্যে এখনো চারজন গ্রেপ্তার হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২৬ জুন সকালে প্রকাশ্যে বরগুনা সরকারি কলেজ গেটের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে আহত করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশাল নেওয়ার পর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন।