প্রতি বছরের মতো ওই বছরও মেলায় গেলাম। ভাগ্যের ফেরে আরেকটা মজার ঘটনা ঘটলো ওই দিন। লেখক হুমায়ূন আহমেদ মেলা দেখতে এসেছেন। অন্যপ্রকাশের স্টলে বিশাল লম্বা লাইন। সেই লাইন লম্বা হয়ে একাডেমির আঙিনার বাইরে চলে গেলো। আমি অভাজনও দাঁড়িয়ে আছি লাইনে। জীবনে প্রথম কারো অটোগ্রাফ নিবো। তাও হুমায়ূন আহমেদের! লাইন কোনো রকম আগায় না। দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা রাম ধাক্কা এলো। সবাই এক-একদিকে উলটে পড়লো। আমি ধাক্কার ছোটে ঢুকে গেলাম বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে। ওদের সামনে টেবিলের বইগুলো আর টেবিল উলটে গেলো আমরা কয়েকজনের ধাক্কায়।
দোকানের একজন এসে আমাকে টেনে তুললো। কনুইয়ের নিচে টেবিলের কোনা লেগে ছিঁড়ে গেছে। হাতের রক্ত মুছতে মুছতে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। এই জীবনে আর কোনো দিন কারো অটোগ্রাফ নিবো না। হুমায়ূন আহমেদ বাসায় এসে অটোগ্রাফ দিতে চাইলেও না। ওটাই আমার প্রথম কারো কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানো। ওটাই শেষ। কোনো দিন আর কারো কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিইনি। ইদানীং তো অটোগ্রাফ নেওয়া আরও সহজ হয়ে গেছে। মেলা এখন বাংলা একাডেমির উঠান ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে এসেছে। দোকান থেকে দোকানের মধ্যে বিশাল ফাঁকা জায়গা। প্রতিটি স্টলে লেখকগণ বিরস মুখে বসে থাকেন। কেউ কেউ গিয়ে অটোগ্রাফ নেন। অনেক লেখক আবার নিজের বই নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য।
গত বছর দেখলাম– একটা স্টলে মুহম্মদ জাফর ইকবাল বসে আছেন। দোকানে তেমন ভিড় নাই। উনি কী একটা বই উলটে পালটে দেখছেন। এই সব লেখকদের জায়গায় হুমায়ূন আহমেদকে ভেবে অবাক লাগে। উনি মেলায় আসলে ওই দিন অন্য প্রকাশের আশপাশের স্টলগুলোর ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যেতো।
এখন আমি অভাজন কীভাবে হুমায়ূন আহমেদের প্রেমে পড়লাম সেই কাহিনি বলি। তখন কলেজে পড়ি। ফার্স্ট ইয়ার। ক্লাস না করে পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়ে বেড়াই। একদিন পড়া শুরু করলাম, ‘হোটেল গ্রেভার ইন’। ওনার আত্মজীবনী টাইপ লেখা। ওই বইয়ে একটা গল্প আছে। ‘বাংলাদেশ নাইট’। প্রবাসী এক ছাত্র মিজানকে নিয়ে লেখা গল্প। মিজান মোরহেড স্টেট ইউনিভার্সিটির একমাত্র বাংলাদেশি ছাত্র। অতিরিক্ত ঠান্ডার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর কোনো বাংলাদেশি ছাত্র পড়তে চায় না। মিজান অনেক ট্রাই করেছে আরও স্টুডেন্ট নিয়ে আসতে। কেউ আসে না।
একবার ইউনিভার্সিটি একটা উৎসব করতে গেলো। এখানকার প্রতিটি দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের দেশ এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে। মিজানও নাম দিয়েছে এই উৎসবে। সে বাংলাদেশকে তুলে ধরবে। কিন্তু সমস্যা হলো সে একা। তার সঙ্গে আর কেউ নাই। ইউনিভার্সিটির ফরেন স্টুডেন্ট অ্যাডভাইজার মিজানকে বুদ্ধি দিলো পাকিস্তানের সাথে আয়োজন করতে। এতে ডেকোরেশনের খরচ কম পড়বে। মিজান তো ফায়ার। অ্যাডভাইজারের কতো সাহস! সে পাকিস্তানিদের সাথে বাংলাদেশ নাইট করতে বলে।
গল্প অনেক লম্বা। এতো লম্বা গল্পের কাহিনি লেখার ধৈর্য আমার নাই। অবশেষে মিজান খেটেখুটে আয়োজন রেডি করলো। সঙ্গে হুমায়ুন আহমেদ আছেন। অনুষ্ঠানের দিন বিকেল বেলা হঠাৎ করে অন্য স্টেট থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করলো। অনুষ্ঠানের বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা অভাজনের নাই। আমরা লেখকের মুখেই এই বর্ণনা শুনি—
“অনুষ্ঠান শুরু হলো দেশাত্মবোধক গান দিয়ে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…।
অন্যান্য স্টেট থেকে মেয়েরা যারা এসেছে, তারাই শুধু গাইছে। এত সুন্দর গাইছে। এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে গান শুনে দেশের জন্যে আমার বুক হু হু করতে লাগল। চোখে জল এসে গেল। কেউ যেন তা দেখতে না পায় সে জন্য মাথা নিচু করে বসে রইলাম।
পরদিন ফার্গোফোরাম পত্রিকায় বাংলাদেশ নাইট সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হলো। খবরের অংশবিশেষ এ রকম—
একটি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ জাতির অনুষ্ঠান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। অনুষ্ঠানটি শুরু হয় দেশের গান দিয়ে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, গান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশি ছেলেমেয়েরা সব কাঁদতে শুরু করল। আমি আমার দীর্ঘদিনের সাংবাদিকতা জীবনে এমন মধুর দৃশ্য দেখিনি…।”
শেষের প্যারাটা পড়ে আমিও কেঁদে উঠলাম হাউমাউ করে। পাবলিক লাইব্রেরিতে এতো মানুষ! আমার কোনো হুঁশ-জ্ঞান নাই। আমি কাঁদছি তো কাঁদছি। হাউমাউ করে কাঁদছি। অন্য টেবিল থেকে উঠে আরেকজন পাঠক দৌড়ে এলো।
“ভাই, কী হইছে? কোনো সমস্যা?”
আমি কান্নার জন্য কোনো জবাবা দিতে পারলাম না।
ওই দিনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে লেখক এতো মমতা নিয়ে যে কোনো জিনিসের বর্ণনা দেন, তার কোনো লেখাই বাদ দেওয়া যাবে না। তার অগণিত পাঠকদের মধ্যে আমিও একজন যে তার সব লেখা পড়ে ফেলেছে।
এই শক্তিমান লেখক আমাকে আরও বহু বইতে কারণে অকারণে এ রকম হু হু করে কাঁদাইছেন।
২০১২ সালের উনিশে জুলাই। টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ টিভির নিচে নিউজ স্ক্রল শুরু হলো। “বাংলাদেশের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ আর নেই। তিনি আমেরিকার…”
ওই দিন আর কোনো কান্না এলো না। আমি শুধু বুঝতে পারছিলাম ভেতরে কী তোলপাড়! বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক আর নাই। একটা ভুল হয়ে গেছে। বিরাট একটা ভুল হয়ে গেছে। অভিমানবশত এই শক্তিমানের অটোগ্রাফ নেওয়া হয়নি আমার। আর কোনো দিন নেওয়া হবে না।
তারপর থেকে এখনো কারো অটোগ্রাফ নিই না আমি। অটোগ্রাফ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহও নাই। শুধু একটাই আফসোস কাজ করে। আর কোনো দিন হুমায়ূন আহমেদের অটোগ্রাফ নেওয়া হবে না আমার। লাইনে দাঁড়িয়েও ছেলেমানুষী অভিমানবশত ওনার অটোগ্রাফ নিইনি, এই দুঃখ আমাকে প্রতিনিয়ত ভোগায়। এই কথা ভেবে ভেবে আমার আর কারো অটোগ্রাফ নেওয়া হয় না।