বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

আজ জাতীয় কবির ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী

প্রফেসর জিন্নাত আলী।।

বিদ্রোহী কবিতায় কবির দৃপ্ত উচ্চারণ- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ পঙ্ক্তি এখনও সব বাঙালির মুক্তির শপথ।

বাংলা সাহিত্যে তার আগমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের এক গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ আজ ১২ ভাদ্র। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী।

১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি বলে গিয়েছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ সে ইচ্ছানুযায়ী কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনও আপস করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে।

শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ভালোবাসা, মুক্তি, বিদ্রোহের মতো বিষয় তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক।

কবির ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। মূলত লেটো দলে যোগদানের মাধ্যমেই সাহিত্যচর্চা অঙ্কুরিত হয়। এ দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা লেখেন।

নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সক্রিয় রাজনীতি করার কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বন্দিদশাতেই তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ অসংখ্য রচনা।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে কাজী নজরুল ইসলাম দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। এ দুই সাহিত্যকর্ম বাংলা পদ্য ও গণসঙ্গীতের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল তখন। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাকাব্য জগতে নতুন দিনের সূচনা হয়। সঙ্গীত রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। রাগ-রাগিণীকে দারুণভাবে খেলিয়েছেন গানে গানে।

ছোটগল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটক লিখলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। ১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা।

বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে। কর্মসূচি : জাতীয় কবির ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করবে বিদ্রোহী কবিকে।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করবে বিশেষ নিবন্ধ। জাতীয় কবির প্রয়াণবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমি কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ‘নজরুলের বিদ্রোহ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মে’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক মোহীত উল আলম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

আজ জাতীয় কবির ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী

প্রকাশের সময় : ০৮:০৫:০২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৯
প্রফেসর জিন্নাত আলী।।

বিদ্রোহী কবিতায় কবির দৃপ্ত উচ্চারণ- ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ পঙ্ক্তি এখনও সব বাঙালির মুক্তির শপথ।

বাংলা সাহিত্যে তার আগমন প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের এক গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছিলেন, ‘আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’ আজ ১২ ভাদ্র। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী।

১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র (১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট) ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবি বলে গিয়েছিলেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ সে ইচ্ছানুযায়ী কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনও আপস করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে।

শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন তিনি সংগ্রাম করে গেছেন। মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ভালোবাসা, মুক্তি, বিদ্রোহের মতো বিষয় তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক।

কবির ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে কাজ করা থেকে শুরু করে মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবেও কাজ করেছেন। মূলত লেটো দলে যোগদানের মাধ্যমেই সাহিত্যচর্চা অঙ্কুরিত হয়। এ দলের বিভিন্ন নাটকের জন্য তিনি গান ও কবিতা লেখেন।

নজরুলের পড়ালেখার হাতেখড়ি হয় মক্তবে। দারিদ্র্যের কারণে মাত্র ১০ বছর বয়সেই পরিবারের ভার বহন করতে হয়েছে তাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন। সক্রিয় রাজনীতি করার কারণে বারবার তাকে কারাবরণ করতে হয়েছে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় তিনি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বন্দিদশাতেই তার হাতে সৃষ্টি হয়েছে গান, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ অসংখ্য রচনা।

১৯২১ সালের ডিসেম্বরে কুমিল্লা থেকে ফেরার পথে কাজী নজরুল ইসলাম দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। এ দুই সাহিত্যকর্ম বাংলা পদ্য ও গণসঙ্গীতের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল তখন। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হয়। এর মাধ্যমে বাংলাকাব্য জগতে নতুন দিনের সূচনা হয়। সঙ্গীত রচনায় নজরুল অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন। রাগ-রাগিণীকে দারুণভাবে খেলিয়েছেন গানে গানে।

ছোটগল্প, উপন্যাস, সঙ্গীত, নাটক লিখলেও মূলত কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। আজীবন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠের কারণে তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। ১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা।

বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি প্রদান করে। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদকে ভূষিত করা হয় কবিকে। কর্মসূচি : জাতীয় কবির ৪৩তম প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করবে বিদ্রোহী কবিকে।

বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করবে বিশেষ নিবন্ধ। জাতীয় কবির প্রয়াণবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমি কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ‘নজরুলের বিদ্রোহ : রাজনীতি, অর্থনীতি ও ধর্মে’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক মোহীত উল আলম। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান