বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

গোটা পৃথিবীকেই বদলে দিতে চলেছে চীন

অফসরাহ মহসিন ।। 

কয়েক দশক আগেও চীনকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল পৃথিবী। এখন পুরো পৃথিবীকেই বদলে দিতে চলেছে দেশটি। পরাশক্তি আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে চীন। তা বুঝতে পেরেই হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ বিশ্বকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলায় চীনাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এখন বাণিজ্য। লিখেছেন পরাগ মাঝি

বিশ্বজুড়ে ছড়ানো প্রকল্প

মিসরে মরুভূমির মতো একটি এলাকায় নির্দয় তপ্ত সূর্যের নিচে ভূমি জরিপ করছে অন্তত এক ডজন চীনা। তারা এই স্থানটিকে মিসরের নতুন প্রাণকেন্দ্র বানাতে চান। ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি বিশাল প্রকল্পের কাজ হতে চলেছে এখানে। একটি মিসরীয় কোম্পানির কাছ থেকে এই কাজটি করার চুক্তি করেছে চীন। চীনা ব্যাংকগুলো এই কাজের অর্থায়ন করবে। এখানে অন্তত ২১টি আকাশচুম্বী দালান নির্মিত হবে। বলা হচ্ছে, এসব ভবনের অন্তত একটি আকার

আকৃতির দিক থেকে আমেরিকার একসময়ের গর্ব অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকেও ছাড়িয়ে যাবে। মিসরের মরুভূমিতে চীনাদের এই শ্রম এবং বদান্যতা তাদের বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার একটি উদাহরণ মাত্র।

কম্বোডিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অর্ধেকই আসে সাতটি বাঁধ থেকে। অর্থের বিনিময়ে এই বাধগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে চীন।

কৌশলগত একটি গভীর স্থলবন্দর স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ধার করেছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তারা যথাসময়ে এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের কাছে। ঋণের বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি লিজ দেওয়া হয়েছে চীনকে।

দক্ষিণ আফ্রিকা একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পায়। সারা পৃথিবীজুড়ে এমন ৬৩টি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে চীন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনাদের বিনিয়োগ কিংবা নির্মাণ করা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো স্পেনের চেয়েও বড় এলাকা দূষণ করছে।

৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফুটবল মাঠ নির্মাণ করতে চায় জাম্বিয়া। এটি নির্মাণ করার জন্য ইতিমধ্যেই চীনের কাছে তারা ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা চেয়েছে। এর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে চীন এমন ছয় শতাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এসব অর্থায়নের মাধ্যমে দেশটি অসংখ্য নতুন বন্ধু এবং এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চীনাদের অর্থায়ন এবং নির্মাণ প্রকল্প চালু আছে বাংলাদেশেও।

এ পৃথিবী বানিয়েছে চীন

পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো খাতে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির স্বপ্ন দেখে চীন। আর এর মধ্য দিয়েই তারা আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিনির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে

পৃথিবীকে পেইচিং-এর আরও কাছে নিয়ে আসাই চীনের লক্ষ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেওয়া মার্শাল পরিকল্পনা আমেরিকাকে সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে স্থায়ী মিত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। তবে, চীনের পরিকল্পনাকে আধুনিক যুগের মার্শাল পরিকল্পনা বললেও ভুল হবে না। কারণ তাদের পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত, আরও ব্যয়বহুল এবং অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক দশকে

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৬০০ প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চীন। এই সহায়তার ক্ষেত্রে কখনো অনুদান, কখনো ঋণ, আবার কখনো বিনিয়োগ আকারে অর্থায়ন করেছে দেশটি। এই সহায়তা পাওয়া দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে চীনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে।

চীনের নির্মিত অন্তত ৪১টি পাইপলাইন দেশটির জ্বালানি তেল এবং গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করেছে। বর্তমানে চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী দেশ। অন্তত ২০৩টি ব্রিজ, রাস্তা এবং রেলওয়ে নির্মাণের মধ্য দিয়ে চীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের পণ্য সরবরাহের পথকে আরও সহজ করেছে।

পারমাণবিক, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং নবায়নযোগ্য অন্তত ১৯৯টি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র দেশটির নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতির কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১১২টি দেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই দেশগুলোর বেশিরভাগকেই চীন সেইসব প্রকল্পে অর্থায়ন কিংবা ঋণ দিয়েছে যেগুলো তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত। বেশ কয়েক বছর দেশের ভেতরেই কয়েকটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করে হাত পাকানোর পর দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বাঁধও নির্মাণ করছে চীন।

ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য

চীনের প্রয়োজন বন্ধু। আর সত্যিকারের সেতুই পারে এমন একটি বন্ধু তৈরি করতে। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সঙ্গে তেল এবং বাণিজ্যের জন্য পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়ার অবস্থান চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দেশগুলোতে বড় বড় বন্দর তৈরি করলে সরবরাহ ব্যবস্থা আরও দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে চীন। ফলে এসব দেশে সম্প্রসারিত ও সুপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে দেশটি। এর মধ্যে চীনের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নেই। কিন্তু এটিও চীনের মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত দেশ বাধ্য হয়েই তার অনুগত থাকবে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় চীনের ‘বকেয়া ফাঁদ’ কূটনীতি।

আলাদা কৌশল

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ভাষ্যমতে, যদি শ্রম এবং পরিবেশের কথা আসে তবে এক্ষেত্রে চীন অন্যদের চেয়ে আলাদা কৌশল অবলম্বন করে। দেশের বাইরের প্রকল্পগুলোতে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের হাজার হাজার নিজস্ব শ্রমিক উড়িয়ে নিয়ে যায়। ফলে যেসব দেশে তাদের প্রকল্পগুলো চলছে সেখানে স্থানীয় মানুষের কর্ম সৃষ্টি হয় কমই। পশ্চিমারা চীনা প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। পশ্চিমাদের ভাষ্য, বাইরে রপ্তানি করা চীনা প্রযুক্তিগুলো দূষণ ছড়ানোর জন্য অনেকাংশেই দূষিত। যেমন- কয়লাচালিত শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র। অভিযোগ আছে, নিজ দেশে জনপ্রিয়তা পায়নি এমন অনেক প্রযুক্তিও বিদেশে রপ্তানি করছে চীন। পশ্চিমা সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশগুলোতে কোনো প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে অনীহা দেখায়। চীন এক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রম। তারা এই ধরনের পরিস্থিতিকে খুব বেশি পাত্তা দেয় না। ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীল দেশগুলোকেও দেদার ঋণ দেওয়াই এর প্রমাণ। চীনের দেওয়া ঋণ সাধারণত উপহারস্বরূপ হয় না। এই ঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোকে অবশ্যই কিছু শর্তের আওতায় আসতে হয়। এসব শর্ত অনেক সময় কোনো দেশকে আরও বেশি ঋণগ্রস্ত করে তোলে।

যে পথ গড়ে তুলছে চীন

চীনের এক মহাপরিকল্পনার নাম ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করা। এই প্রকল্পের দুটি অংশ। একটি হলো সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট, অন্যটি সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড। প্রথমত সড়কপথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও সংযুক্ত করছে চীন। প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে দেশটি। প্রাচীন সিল্ক রুট প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’-এর আওতায় নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে। ফলে এই বেল্টের সঙ্গে যুক্ত থাকা সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর মানচিত্রে দেখা যায়, চীনের সিয়ান থেকে উরুমকি, তুরস্কের ইস্তান্বুল এবং ইউরোপে স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে, যা মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান হয়ে মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানির হামবুর্গ, হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে মাদ্রিদে গিয়ে শেষ হবে।

এছাড়াও চীন একটি সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে। সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগর, প্রশান্ত সহাসাগর, ভারত মহাসাগর এক সুতায় বাঁধা পড়বে। ফলে আফ্রিকা উপকূলও চলে আসবে চীনের প্রভাব বলয়ে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটা সেই প্রাচীন সমুদ্র ও সড়কপথের সিল্ক রোড পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, যে রাস্তা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। মহা এই চ্যালেঞ্জ ঘিরেই চীনের যত অর্থনৈতিক কূটনীতি।

বস্তুত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর আওতায় চীন দুটো ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। দ্বিতীয়টি, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়ক পথ। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য মহাসাগর অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেল এ পথে খুব অল্প সময়ে চীনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তার ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-কক্সবাজার-কলকাতা সড়কপথ নির্মাণ করতে হবে। এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশ সড়কপথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। এতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে।

নতুন পরাশক্তি

সময়টা তখন ১৯৮৪ সালের শরৎ। পৃথিবীর এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন আমেরিকার নতুন সূর্যোদয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন পৃথিবীর অপরপ্রান্তে থাকা চীন তখন কয়েক দশকের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সে সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চল উন্নতি করা শুরু করলেও দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমায় অবস্থান করছিল। কিন্তু এ সবই এখন তাদের দুঃসময়ের স্মৃতি।

তিন দশকের ব্যবধানে পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এখন চীন। যে পৃথিবী নির্মাণ করে চলেছে চীন তা বাস্তবায়ন হলে অদূর ভবিষ্যতে তারাই হবে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি। চীনের শক্তিশালী হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কেউ কেউ দাবি করেন, ২০১৪ সালেই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১৭ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ শতাংশ। জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটির চেয়ে অনেক পেছনে আছে চীন। তবে, ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন। ধারণা করা হচ্ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ২০২০ সালের মধ্যে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মার্কিন মুদ্রা ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে।

আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে চীন। সে সময় উভয় দেশের জিডিপি হবে ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তৃতীয় কোনো দেশ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছে নেই। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তির মতো প্রায় সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে চীন।

নতুন পরাশক্তি হয়ে উঠতে চীনের সামরিক বাহিনীকে কোনো ভূমিকাই রাখতে হয়নি বলা যায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে সম্পর্ক গড়ছে। এই যেমন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন।

এই মহাদেশে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে তারা। একটি গরিব দেশকে কয়েক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না। অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মী বাহিনী দিয়ে তারা উৎপাদন ও বাণিজ্যে অন্যদের হারিয়ে দিয়েছে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

গোটা পৃথিবীকেই বদলে দিতে চলেছে চীন

প্রকাশের সময় : ০৭:৩১:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ অগাস্ট ২০১৯
অফসরাহ মহসিন ।। 

কয়েক দশক আগেও চীনকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল পৃথিবী। এখন পুরো পৃথিবীকেই বদলে দিতে চলেছে দেশটি। পরাশক্তি আমেরিকার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে চীন। তা বুঝতে পেরেই হয়তো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। কারণ বিশ্বকে নিজেদের মতো করে গড়ে তোলায় চীনাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র এখন বাণিজ্য। লিখেছেন পরাগ মাঝি

বিশ্বজুড়ে ছড়ানো প্রকল্প

মিসরে মরুভূমির মতো একটি এলাকায় নির্দয় তপ্ত সূর্যের নিচে ভূমি জরিপ করছে অন্তত এক ডজন চীনা। তারা এই স্থানটিকে মিসরের নতুন প্রাণকেন্দ্র বানাতে চান। ৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে একটি বিশাল প্রকল্পের কাজ হতে চলেছে এখানে। একটি মিসরীয় কোম্পানির কাছ থেকে এই কাজটি করার চুক্তি করেছে চীন। চীনা ব্যাংকগুলো এই কাজের অর্থায়ন করবে। এখানে অন্তত ২১টি আকাশচুম্বী দালান নির্মিত হবে। বলা হচ্ছে, এসব ভবনের অন্তত একটি আকার

আকৃতির দিক থেকে আমেরিকার একসময়ের গর্ব অ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংকেও ছাড়িয়ে যাবে। মিসরের মরুভূমিতে চীনাদের এই শ্রম এবং বদান্যতা তাদের বৈশ্বিক আকাক্সক্ষার একটি উদাহরণ মাত্র।

কম্বোডিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার অর্ধেকই আসে সাতটি বাঁধ থেকে। অর্থের বিনিময়ে এই বাধগুলো নির্মাণ করে দিয়েছে চীন।

কৌশলগত একটি গভীর স্থলবন্দর স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ধার করেছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু তারা যথাসময়ে এই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে গভীর সমুদ্রবন্দরটির নিয়ন্ত্রণ এখন চীনের কাছে। ঋণের বিনিময়ে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি লিজ দেওয়া হয়েছে চীনকে।

দক্ষিণ আফ্রিকা একটি কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চীনের কাছ থেকে দেড় বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পায়। সারা পৃথিবীজুড়ে এমন ৬৩টি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্রে বিনিয়োগ করেছে চীন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনাদের বিনিয়োগ কিংবা নির্মাণ করা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো স্পেনের চেয়েও বড় এলাকা দূষণ করছে।

৫০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি ফুটবল মাঠ নির্মাণ করতে চায় জাম্বিয়া। এটি নির্মাণ করার জন্য ইতিমধ্যেই চীনের কাছে তারা ৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা চেয়েছে। এর আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে চীন এমন ছয় শতাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এসব অর্থায়নের মাধ্যমে দেশটি অসংখ্য নতুন বন্ধু এবং এবং নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। চীনাদের অর্থায়ন এবং নির্মাণ প্রকল্প চালু আছে বাংলাদেশেও।

এ পৃথিবী বানিয়েছে চীন

পৃথিবীজুড়ে ব্যবসা, বিনিয়োগ এবং অবকাঠামো খাতে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরির স্বপ্ন দেখে চীন। আর এর মধ্য দিয়েই তারা আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন এবং ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিনির্মাণের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে

পৃথিবীকে পেইচিং-এর আরও কাছে নিয়ে আসাই চীনের লক্ষ্য।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপিয়ান দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেওয়া মার্শাল পরিকল্পনা আমেরিকাকে সামরিক এবং কূটনৈতিক ক্ষেত্রে স্থায়ী মিত্র তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। তবে, চীনের পরিকল্পনাকে আধুনিক যুগের মার্শাল পরিকল্পনা বললেও ভুল হবে না। কারণ তাদের পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত, আরও ব্যয়বহুল এবং অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণও বটে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক দশকে

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রায় ৬০০ প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চীন। এই সহায়তার ক্ষেত্রে কখনো অনুদান, কখনো ঋণ, আবার কখনো বিনিয়োগ আকারে অর্থায়ন করেছে দেশটি। এই সহায়তা পাওয়া দেশগুলো স্বাভাবিকভাবে চীনের প্রতি আনুগত্য দেখাবে।

চীনের নির্মিত অন্তত ৪১টি পাইপলাইন দেশটির জ্বালানি তেল এবং গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করেছে। বর্তমানে চীন দ্বিতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল ব্যবহারকারী দেশ। অন্তত ২০৩টি ব্রিজ, রাস্তা এবং রেলওয়ে নির্মাণের মধ্য দিয়ে চীন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের পণ্য সরবরাহের পথকে আরও সহজ করেছে।

পারমাণবিক, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং নবায়নযোগ্য অন্তত ১৯৯টি শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র দেশটির নির্মাণ এবং যন্ত্রপাতির কোম্পানিগুলোর জন্য নতুন বাজার সৃষ্টি করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর গবেষণায় দেখা গেছে, অন্তত ১১২টি দেশ বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য চীনের কাছ থেকে অর্থ সহায়তা নিয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, এই দেশগুলোর বেশিরভাগকেই চীন সেইসব প্রকল্পে অর্থায়ন কিংবা ঋণ দিয়েছে যেগুলো তাদের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত। বেশ কয়েক বছর দেশের ভেতরেই কয়েকটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করে হাত পাকানোর পর দেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বাঁধও নির্মাণ করছে চীন।

ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য

চীনের প্রয়োজন বন্ধু। আর সত্যিকারের সেতুই পারে এমন একটি বন্ধু তৈরি করতে। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সঙ্গে তেল এবং বাণিজ্যের জন্য পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়ার অবস্থান চীনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই দেশগুলোতে বড় বড় বন্দর তৈরি করলে সরবরাহ ব্যবস্থা আরও দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে চীন। ফলে এসব দেশে সম্প্রসারিত ও সুপ্রশস্ত রাস্তা নির্মাণে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে দেশটি। এর মধ্যে চীনের ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা এই মুহূর্তে পাকিস্তানের নেই। কিন্তু এটিও চীনের মহাপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে ঋণগ্রস্ত দেশ বাধ্য হয়েই তার অনুগত থাকবে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় চীনের ‘বকেয়া ফাঁদ’ কূটনীতি।

আলাদা কৌশল

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ভাষ্যমতে, যদি শ্রম এবং পরিবেশের কথা আসে তবে এক্ষেত্রে চীন অন্যদের চেয়ে আলাদা কৌশল অবলম্বন করে। দেশের বাইরের প্রকল্পগুলোতে চীনা কোম্পানিগুলো তাদের হাজার হাজার নিজস্ব শ্রমিক উড়িয়ে নিয়ে যায়। ফলে যেসব দেশে তাদের প্রকল্পগুলো চলছে সেখানে স্থানীয় মানুষের কর্ম সৃষ্টি হয় কমই। পশ্চিমারা চীনা প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। পশ্চিমাদের ভাষ্য, বাইরে রপ্তানি করা চীনা প্রযুক্তিগুলো দূষণ ছড়ানোর জন্য অনেকাংশেই দূষিত। যেমন- কয়লাচালিত শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র। অভিযোগ আছে, নিজ দেশে জনপ্রিয়তা পায়নি এমন অনেক প্রযুক্তিও বিদেশে রপ্তানি করছে চীন। পশ্চিমা সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সাধারণত রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল দেশগুলোতে কোনো প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে অনীহা দেখায়। চীন এক্ষেত্রে বেশ ব্যতিক্রম। তারা এই ধরনের পরিস্থিতিকে খুব বেশি পাত্তা দেয় না। ভেনেজুয়েলা, নাইজেরিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মতো রাজনৈতিক অস্থিতিশীল দেশগুলোকেও দেদার ঋণ দেওয়াই এর প্রমাণ। চীনের দেওয়া ঋণ সাধারণত উপহারস্বরূপ হয় না। এই ঋণের মাধ্যমে ঋণগ্রহীতা দেশগুলোকে অবশ্যই কিছু শর্তের আওতায় আসতে হয়। এসব শর্ত অনেক সময় কোনো দেশকে আরও বেশি ঋণগ্রস্ত করে তোলে।

যে পথ গড়ে তুলছে চীন

চীনের এক মহাপরিকল্পনার নাম ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’। এই পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো- এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের অন্তত ৭০টি দেশের সঙ্গে চীনের মূল ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করা। এই প্রকল্পের দুটি অংশ। একটি হলো সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট, অন্যটি সমুদ্রগামী মেরিটাইম সিল্ক রোড। প্রথমত সড়কপথে মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত হবে চীন। সড়ক পথের সঙ্গে রেলপথ ও তেলের পাইপলাইনও সংযুক্ত করছে চীন। প্রাচীন সিল্ক রুটের আধুনিক সংস্করণ হিসেবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে দেশটি। প্রাচীন সিল্ক রুট প্রায় ২ হাজার বছরের পুরনো। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’-এর আওতায় নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে। ফলে এই বেল্টের সঙ্গে যুক্ত থাকা সব দেশেরই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।

‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর মানচিত্রে দেখা যায়, চীনের সিয়ান থেকে উরুমকি, তুরস্কের ইস্তান্বুল এবং ইউরোপে স্পেনের মাদ্রিদ পর্যন্ত সড়কপথ তৈরি হবে, যা মধ্য এশিয়ার কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান হয়ে মস্কো, পোল্যান্ড, জার্মানির হামবুর্গ, হল্যান্ডের রটারডাম হয়ে মাদ্রিদে গিয়ে শেষ হবে।

এছাড়াও চীন একটি সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মহাপরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করছে। সামুদ্রিক সিল্ক রোডের মাধ্যমে দক্ষিণ চীন সাগর, প্রশান্ত সহাসাগর, ভারত মহাসাগর এক সুতায় বাঁধা পড়বে। ফলে আফ্রিকা উপকূলও চলে আসবে চীনের প্রভাব বলয়ে।

চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এটা সেই প্রাচীন সমুদ্র ও সড়কপথের সিল্ক রোড পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, যে রাস্তা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। মহা এই চ্যালেঞ্জ ঘিরেই চীনের যত অর্থনৈতিক কূটনীতি।

বস্তুত ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর আওতায় চীন দুটো ‘ইকোনমিক করিডর’ সৃষ্টি করছে। একটি কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক ও রেলপথ। দ্বিতীয়টি, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের খাসগর থেকে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওদার পর্যন্ত রেল ও সড়ক পথ। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে তেলের পাইপলাইন সংযুক্ত হবে। পারস্য মহাসাগর অঞ্চল এবং মধ্য এশিয়ার জ্বালানি তেল এ পথে খুব অল্প সময়ে চীনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে চীন এই অর্থনৈতিক করিডরের সঙ্গে তার ইউনান প্রদেশকেও সংযুক্ত করতে চায়। এটা করতে হলে কুনমিং-কক্সবাজার-কলকাতা সড়কপথ নির্মাণ করতে হবে। এটি নির্মিত হলে বাংলাদেশ সড়কপথে চীনা পণ্য আমদানি করতে পারবে। এতে সময় বাঁচবে ও পণ্যের মূল্য কমে যাবে।

নতুন পরাশক্তি

সময়টা তখন ১৯৮৪ সালের শরৎ। পৃথিবীর এক প্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান যখন আমেরিকার নতুন সূর্যোদয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন পৃথিবীর অপরপ্রান্তে থাকা চীন তখন কয়েক দশকের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সে সময় চীনের বিভিন্ন অঞ্চল উন্নতি করা শুরু করলেও দেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমায় অবস্থান করছিল। কিন্তু এ সবই এখন তাদের দুঃসময়ের স্মৃতি।

তিন দশকের ব্যবধানে পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া আধিপত্যের দিন শেষ হতে চলেছে। তাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী এখন চীন। যে পৃথিবী নির্মাণ করে চলেছে চীন তা বাস্তবায়ন হলে অদূর ভবিষ্যতে তারাই হবে পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি। চীনের শক্তিশালী হয়ে ওঠার সবচেয়ে বড় কারণ তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। কেউ কেউ দাবি করেন, ২০১৪ সালেই অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে চীন।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর হিসেব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে চীনের জিডিপি ছিল ১৭ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ শতাংশ। জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে দেশটির চেয়ে অনেক পেছনে আছে চীন। তবে, ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালে মাথাপিছু আয়ের দিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে চীন। ধারণা করা হচ্ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান ২০২০ সালের মধ্যে রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে মার্কিন মুদ্রা ডলারকে ছাড়িয়ে যাবে।

আরেকটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হবে চীন। সে সময় উভয় দেশের জিডিপি হবে ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার। তৃতীয় কোনো দেশ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ধারেকাছে নেই। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তির মতো প্রায় সব ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রকে তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে চীন।

নতুন পরাশক্তি হয়ে উঠতে চীনের সামরিক বাহিনীকে কোনো ভূমিকাই রাখতে হয়নি বলা যায়। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে সম্পর্ক গড়ছে। এই যেমন দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে অন্তত ৩০ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে চীন।

এই মহাদেশে ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলেছে তারা। একটি গরিব দেশকে কয়েক দশকের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করাটা খুব সহজ কাজ ছিল না। অত্যন্ত দক্ষ ও শিক্ষিত কর্মী বাহিনী দিয়ে তারা উৎপাদন ও বাণিজ্যে অন্যদের হারিয়ে দিয়েছে।