বুধবার, ০৭ জুন ২০২৩, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নিজেকে পুরোনো ভাবেন না শিরিন আক্তার

মো: নুরুজ্জামান লিটন ।। 

মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে আবারও শ্রেষ্ঠত্ব শিরিন আক্তারের। শুক্রবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ১৫তম সামার মিটে জিতে নিলেন সোনা। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই অ্যাথলেট সামার অ্যাথলেটিকস ও ন্যাশনাল অ্যাথলেটিকস মিলে টানা ৯ বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টের রানি।

গত ন্যাশনালে টানা আটবার স্প্রিন্টে সেরা হওয়ার রেকর্ড গড়েন। এবার নিজের সেই রেকর্ডটাই আরও সুসংহত করলেন সাতক্ষীরার এই মেয়ে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা শিরিন এখানেই থামতে চান না। নিজেকে নিয়ে যেতে চান অনন্য উচ্চতায়।

স্প্রিন্টে আবারও সেরা হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশ রূপান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘আমি আসলে থামতে চাই না। যতবার সম্ভব ততবারই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে চাই। দেশকে এখন আমি একটা স্বর্ণ পদক উপহার দিতে চাই এসএ গেমসে।’

স্প্রিন্টে শিরিনের এই রাজত্ব শুরু ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসের পর থেকে। বাংলাদেশ গেমসেই শিরিন প্রথম দৌড়ান সিনিয়র প্রতিযোগিতায়। ২০০৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত খেলেছেন জুনিয়র প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ গেমসে জাকিয়া সুলতানা ও নাজমুন নাহার বিউটির সঙ্গে লড়ে হন দ্বিতীয়।

এরপর ন্যাশনাল ও সামার প্রতিযোগিতায় প্রতিবারই সেরা শিরিন।

কীভাবে সম্ভব এমন দাপট ধরে রাখা? আবারও স্প্রিন্টে সেরা হয়ে তৃপ্ত শিরিন বলছিলেন, ‘আসলে ওরাও (অন্য প্রতিযোগী) পরিশ্রম করছে। যেমন- শারীফা আক্তার, সোহাগী আক্তার, রুপা খাতুন। ওরাও বেশ ভালো। কে কখন ভালো করবে এটা বলা যায় না। আমি যে পরিশ্রম করেছিলাম, সম্পূর্ণটা হয়তো দিতে পেরেছি। এ জন্যই হয়তো আমি প্রথম হয়েছি। চেষ্টা করব ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভালো কিছু করতে। ওরা আসলে ভালো করেছে, খারাপ করেনি।’

সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন ২০০৭ সালে ভর্তি হন বিকেএসপিতে। ছোট বেলা থেকেই দৌড়ঝাঁপ করে কাটত সময়। স্কুলে শুধু পুরস্কারের আশায় নিয়মিত খেলতেন বলে হাসতে হাসতে জানান, ‘আমি প্রথম হতাম সব সময়। অনেকগুলো পুরস্কারই পেতাম। প্রথম হলে ছোট বাচ্চাদের কোলে তুলে নেয়। কোলে উঠব, সবাই আমাকে দেখবে, আমার নামটা সবার মাঝে পরিচিত হবে, এটার জন্যই আমি বেশি আগ্রহী ছিলাম।’

ছয় বছর ধরে প্রতিবার সেরা শিরিন। ছেলেদের স্প্রিন্টে শিরিনের সঙ্গে টানা রাজত্ব করছিলেন বিকেএসপিতে শিরিনেরই সতীর্থ মেজবাহ আহমেদ। তবে মেজবাহর সেই আধিপত্য ক্ষুণ্ন হয়েছে। শিরিন এগিয়ে চলেছেন নিজস্ব গতিতে। সামার অ্যাথলেটিকস ও ন্যাশনাল প্রতিযোগিতার পর পুরোনো রানি, নতুন রাজা শিরোনামে ভরে যায় পত্রিকার পাতা।

শিরিনের অবশ্য পুরোনো রানি কথাটায় আপত্তি, ‘আসলে পুরোনো না। সবাই নতুন। আমি পুরাতন- বিষয়টা এমন না, প্রতিবার সবকিছু নতুনভাবেই শুরু করতে হয়। পরিশ্রমটাই আসল। নতুন না পুরাতন এসব কোনো প্রভাব ফেলে না। আমাদের প্রেক্ষাপটে আমরা ছোটবেলা থেকে তেমন একটা খেলতে পারি না। আর এমন পরিস্থিতি আসে আমাদের প্রায়ই একটা জায়গায় থেমে যেতে হয়। আমি সব সময় চাই থেমে না থাকতে। নতুনদের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করতে।’

শুধু ট্র্যাকে নয়, শিরিন সফল পড়াশোনাতেও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মাস্টার্স করছেন। সারা বছর বিকেএসপিতে ট্রেনিং করেন সাবেক অ্যাথলেট আব্দুল্লাহ হেল কাফীর অধীনে। এর মাঝেই পরীক্ষা-ক্লাস করতে নিয়মিতই ছুটতে হয় রাজশাহীতে। ট্র্যাকের চিন্তা ঝেড়ে ১০ সেপ্টেম্বর যেমন বসতে হবে পরীক্ষার টেবিলে। তবু শিরিন এগিয়ে চলেছেন সব সামলে। শিরিন এজন্য কৃতজ্ঞতা জানান অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, নিজ সংস্থা নৌবাহিনী, বিকেএসপি- সবার প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধুদের প্রতিও জানান কৃতজ্ঞতা।

শিরিনের লক্ষ্য এখন নেপাল এসএ গেমস। যেখানে দেশকে পদক দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে তৈরি করছেন তিনি।

তবে অ্যাথলেটিকসে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের পারফরম্যান্স হতাশজনক। আসলে দেশে রাজত্ব করলেও বিদেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলা হয় না বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের। শিলং-গুয়াহাটিতে যেমন দেশের ইতিহাসে সেরা টাইমিং (১১.৯৯) করেও ১০০ মিটারে পদকের দেখা পাননি শিরিন।

এবার এসএ গেমসে পদকের লক্ষ্য থাকলেও বললেন, ‘আসলে বলা যতটা সহজ, করা ততটা কঠিন। সেই হিসেবে যতটা পরিশ্রম করা দরকার, ততটা পরিশ্রম করব।’

পরিশ্রমটা আসলে বেশিই করতে হবে। গতবার এসএ গেমসে যে টাইমিং করেছেন, এবারের সামারে টাইমিংটা যে তার চেয়ে অনেক পেছনে। ১২.২০ টাইমিং করে সেরা হয়েছেন শিরিন। ডিসেম্বরে এসএ গেমসে পদক জিততে হলে তাই অবিশ্বাস্য কিছু করতে হবে তাকে। তা নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন শিরিন?

‘নিজেকে কীভাবে তৈরি করব সেটা আমার স্যার ভাবছেন। কাফি স্যার আমাকে নিয়ে যেভাবে পরিকল্পনা করছেন, আমি শুধু তার শিডিউল অনুযায়ী পরিশ্রম করে যাব। স্যারকে বলেছি, আমার যতটা পরিশ্রম করা দরকার করব। শুধু আমাকে সেই জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আপনার।’

দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রতিযোগীদের খোঁজও নিয়মিত রাখছেন। যা থেকে শিরিনের বিশ্বাস, ‘তাদের কাছাকাছি যাওয়া অসম্ভব কিছু না। সে জন্য যে সাপোর্ট দরকার সেটা সবার কাছ থেকে পাচ্ছি। আরও ভালো পেলে ইনশা আল্লাহ আরও ভালো কিছু করতে পারব।’

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

নিজেকে পুরোনো ভাবেন না শিরিন আক্তার

প্রকাশের সময় : ০৯:৪২:২৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ অগাস্ট ২০১৯
মো: নুরুজ্জামান লিটন ।। 

মেয়েদের ১০০ মিটার স্প্রিন্টে আবারও শ্রেষ্ঠত্ব শিরিন আক্তারের। শুক্রবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ১৫তম সামার মিটে জিতে নিলেন সোনা। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এই অ্যাথলেট সামার অ্যাথলেটিকস ও ন্যাশনাল অ্যাথলেটিকস মিলে টানা ৯ বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টের রানি।

গত ন্যাশনালে টানা আটবার স্প্রিন্টে সেরা হওয়ার রেকর্ড গড়েন। এবার নিজের সেই রেকর্ডটাই আরও সুসংহত করলেন সাতক্ষীরার এই মেয়ে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা শিরিন এখানেই থামতে চান না। নিজেকে নিয়ে যেতে চান অনন্য উচ্চতায়।

স্প্রিন্টে আবারও সেরা হয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে দেশ রূপান্তরকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, ‘আমি আসলে থামতে চাই না। যতবার সম্ভব ততবারই শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে চাই। দেশকে এখন আমি একটা স্বর্ণ পদক উপহার দিতে চাই এসএ গেমসে।’

স্প্রিন্টে শিরিনের এই রাজত্ব শুরু ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসের পর থেকে। বাংলাদেশ গেমসেই শিরিন প্রথম দৌড়ান সিনিয়র প্রতিযোগিতায়। ২০০৭ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হয়ে ২০১২ সাল পর্যন্ত খেলেছেন জুনিয়র প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশ গেমসে জাকিয়া সুলতানা ও নাজমুন নাহার বিউটির সঙ্গে লড়ে হন দ্বিতীয়।

এরপর ন্যাশনাল ও সামার প্রতিযোগিতায় প্রতিবারই সেরা শিরিন।

কীভাবে সম্ভব এমন দাপট ধরে রাখা? আবারও স্প্রিন্টে সেরা হয়ে তৃপ্ত শিরিন বলছিলেন, ‘আসলে ওরাও (অন্য প্রতিযোগী) পরিশ্রম করছে। যেমন- শারীফা আক্তার, সোহাগী আক্তার, রুপা খাতুন। ওরাও বেশ ভালো। কে কখন ভালো করবে এটা বলা যায় না। আমি যে পরিশ্রম করেছিলাম, সম্পূর্ণটা হয়তো দিতে পেরেছি। এ জন্যই হয়তো আমি প্রথম হয়েছি। চেষ্টা করব ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভালো কিছু করতে। ওরা আসলে ভালো করেছে, খারাপ করেনি।’

সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন ২০০৭ সালে ভর্তি হন বিকেএসপিতে। ছোট বেলা থেকেই দৌড়ঝাঁপ করে কাটত সময়। স্কুলে শুধু পুরস্কারের আশায় নিয়মিত খেলতেন বলে হাসতে হাসতে জানান, ‘আমি প্রথম হতাম সব সময়। অনেকগুলো পুরস্কারই পেতাম। প্রথম হলে ছোট বাচ্চাদের কোলে তুলে নেয়। কোলে উঠব, সবাই আমাকে দেখবে, আমার নামটা সবার মাঝে পরিচিত হবে, এটার জন্যই আমি বেশি আগ্রহী ছিলাম।’

ছয় বছর ধরে প্রতিবার সেরা শিরিন। ছেলেদের স্প্রিন্টে শিরিনের সঙ্গে টানা রাজত্ব করছিলেন বিকেএসপিতে শিরিনেরই সতীর্থ মেজবাহ আহমেদ। তবে মেজবাহর সেই আধিপত্য ক্ষুণ্ন হয়েছে। শিরিন এগিয়ে চলেছেন নিজস্ব গতিতে। সামার অ্যাথলেটিকস ও ন্যাশনাল প্রতিযোগিতার পর পুরোনো রানি, নতুন রাজা শিরোনামে ভরে যায় পত্রিকার পাতা।

শিরিনের অবশ্য পুরোনো রানি কথাটায় আপত্তি, ‘আসলে পুরোনো না। সবাই নতুন। আমি পুরাতন- বিষয়টা এমন না, প্রতিবার সবকিছু নতুনভাবেই শুরু করতে হয়। পরিশ্রমটাই আসল। নতুন না পুরাতন এসব কোনো প্রভাব ফেলে না। আমাদের প্রেক্ষাপটে আমরা ছোটবেলা থেকে তেমন একটা খেলতে পারি না। আর এমন পরিস্থিতি আসে আমাদের প্রায়ই একটা জায়গায় থেমে যেতে হয়। আমি সব সময় চাই থেমে না থাকতে। নতুনদের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে তৈরি করতে।’

শুধু ট্র্যাকে নয়, শিরিন সফল পড়াশোনাতেও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে মাস্টার্স করছেন। সারা বছর বিকেএসপিতে ট্রেনিং করেন সাবেক অ্যাথলেট আব্দুল্লাহ হেল কাফীর অধীনে। এর মাঝেই পরীক্ষা-ক্লাস করতে নিয়মিতই ছুটতে হয় রাজশাহীতে। ট্র্যাকের চিন্তা ঝেড়ে ১০ সেপ্টেম্বর যেমন বসতে হবে পরীক্ষার টেবিলে। তবু শিরিন এগিয়ে চলেছেন সব সামলে। শিরিন এজন্য কৃতজ্ঞতা জানান অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন, নিজ সংস্থা নৌবাহিনী, বিকেএসপি- সবার প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বন্ধুদের প্রতিও জানান কৃতজ্ঞতা।

শিরিনের লক্ষ্য এখন নেপাল এসএ গেমস। যেখানে দেশকে পদক দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে তৈরি করছেন তিনি।

তবে অ্যাথলেটিকসে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের প্রতিযোগীদের পারফরম্যান্স হতাশজনক। আসলে দেশে রাজত্ব করলেও বিদেশের প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলা হয় না বাংলাদেশের অ্যাথলেটদের। শিলং-গুয়াহাটিতে যেমন দেশের ইতিহাসে সেরা টাইমিং (১১.৯৯) করেও ১০০ মিটারে পদকের দেখা পাননি শিরিন।

এবার এসএ গেমসে পদকের লক্ষ্য থাকলেও বললেন, ‘আসলে বলা যতটা সহজ, করা ততটা কঠিন। সেই হিসেবে যতটা পরিশ্রম করা দরকার, ততটা পরিশ্রম করব।’

পরিশ্রমটা আসলে বেশিই করতে হবে। গতবার এসএ গেমসে যে টাইমিং করেছেন, এবারের সামারে টাইমিংটা যে তার চেয়ে অনেক পেছনে। ১২.২০ টাইমিং করে সেরা হয়েছেন শিরিন। ডিসেম্বরে এসএ গেমসে পদক জিততে হলে তাই অবিশ্বাস্য কিছু করতে হবে তাকে। তা নিজেকে কীভাবে তৈরি করছেন শিরিন?

‘নিজেকে কীভাবে তৈরি করব সেটা আমার স্যার ভাবছেন। কাফি স্যার আমাকে নিয়ে যেভাবে পরিকল্পনা করছেন, আমি শুধু তার শিডিউল অনুযায়ী পরিশ্রম করে যাব। স্যারকে বলেছি, আমার যতটা পরিশ্রম করা দরকার করব। শুধু আমাকে সেই জায়গা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আপনার।’

দক্ষিণ এশিয়ার সেরা প্রতিযোগীদের খোঁজও নিয়মিত রাখছেন। যা থেকে শিরিনের বিশ্বাস, ‘তাদের কাছাকাছি যাওয়া অসম্ভব কিছু না। সে জন্য যে সাপোর্ট দরকার সেটা সবার কাছ থেকে পাচ্ছি। আরও ভালো পেলে ইনশা আল্লাহ আরও ভালো কিছু করতে পারব।’