বুধবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৫, ৮ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বছরে পাচার ৩২৪ কোটি টাকা

সাজ্জাদুল ইসলাম সৌরভ ।।

অনলাইন ক্যাসিনোর আয় থেকে প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা পাচার করেছেন সেলিম প্রধান। তিনটি ‘গেটওয়ে’র মাধ্যমে গত এক বছরে অনলাইন ক্যাসিনো গুরু এই অর্থ পাচার করেন। সেলিম বলেছেন, একটি গেটওয়ে দিয়ে মাসে পাচার করতেন প্রায় ৯ কোটি টাকা।

এই গেটওয়ে-সংক্রান্ত কাগজপত্রও র‌্যাবের হাতে এসেছে। বাকি দুটির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এদিকে এই তিনটি গেটওয়ের বাইরে সেলিম লন্ডনেও টাকা পাচার করছেন। গ্রেফতারের পর র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাথমিকভাবে তিনি এ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

তারেক রহমানের সহযোগী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিমের ঘনিষ্ঠতা আছে। ২০০১-০৬ সালের মধ্যে তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দেন। সোমবার গ্রেফতারের পর র‌্যাব তাকে অনেকটা সময় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এদিকে র‌্যাব সোম ও মঙ্গলবার ২০ ঘণ্টা ধরে তার দুটি অফিসে অভিযান চালিয়ে নগদ ২৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা সমমূল্যের ২৩ দেশের মুদ্রা, ৩২টি চেকবই, ১২টি পাসপোর্ট, ৪৮ বোতল মদ, তিনটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করেছে।

সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে। এছাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য গুলশান-২ এর ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় সেলিম প্রধানের একটি অফিস আছে। এছাড়া বনানীর ২ নম্বর বোডের ১১ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলায়ও তার আরও একটি অফিস আছে।

সোমবার রাত ৮ থেকে র‌্যাব তাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি অফিসেই অভিযান চালায়। মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত অভিযান চলে। অভিযান শেষে মঙ্গলবার বিকালে গুলশান-২ এর বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।

তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু’র পরামর্শে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর ব্যবসা শুরু করে সেলিম প্রধান। সব ধরনের কারিগরি সহায়তাও দেয় মি. দু। ব্যবসার অর্ধেক অংশীদারও উত্তর কোরিয়ার এই নাগরিক। এই ব্যবসা থেকে আয়ের অধিকাংশ অর্থই বিদেশে পাচার হয়েছে।

একটি ‘গেটওয়ে’ থেকেই মাসে পাচার হতো প্রায় ৯ কোটি টাকা। এরকম তিনটি ‘গেটওয়ে’র বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনটি গেটওয়ে দিয়ে এক বছর ধরে ক্যাসিনোর টাকা পাচার করছে।

আরও গেটওয়ে আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র‌্যাবের অপর এক সূত্র জানায়, তিন গেটওয়ে দিয়ে সেলিম মাসে ২৭ কোটি এবং বছরে ৩২৪ কোটি টাকা পাচার করেছে।

সোমবার সেলিম প্রধানকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে গ্রেফতার করে নামিয়ে আনা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযানে নামে র‌্যাব।

এতে দেশি-বিদেশি টাকা, মদসহ অনলাইন গেমিংয়ের ডাটা সংরক্ষণের কম্পিউটার, চারটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। পরে বনানীর একটি বাসায় সেলিমের আরেকটি অফিসে অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়।

অভিযানে সেলিমের দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান এবং মো. রোমানকে গ্রেফতার করা হয়।

অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব-১’র অধিনায়ক বলেন, আমাদের একটি অনলাইন মনিটরিং সেল রয়েছে। ওই টিম দেখতে পায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করছে।

তারপর এই চক্রকে ধরতে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। গোপন খবরের ভিত্তিতে সোমবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর বাংলাদেশ প্রধান ও সমন্বয়ক সেলিম প্রধানকে।

তিনি থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান-২ নম্বরে তার অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তার অফিস থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাগজ-পত্রও পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই ব্যবসাটি সেলিম কোরীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধান।

এই ব্যবসার ৫০ শতাংশের মালিকানা তার এবং বাকি ৫০ শতাংশের অংশীদার উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু।

সেলিম যেভাবে ক্যাসিনো ব্যবসায় : র‌্যাব জানায়, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় সেলিমের জন্ম। ১৯৮৮ সালে তিনি জাপানে যান। সেখানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে মিলে গাড়ি ব্যবসায় নাম লেখান।

পরে জাপানিদের সঙ্গেই পার্টনারশিপে থাইল্যান্ডে শিপইয়ার্ডের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। জাপানিদের মাধ্যমেই উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু’র সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মি. দু বাংলাদেশে কনস্ট্রাকশন ব্যবসায় আগ্রহ প্রকাশ করেন।

ধীরে ধীরে সেলিমের সঙ্গে সখ্য বাড়ার পর মি. দু তাকে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার পরিকল্পনার কথা বলেন। ২০১৮ সালে মি. দু এবং সেলিম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন।

পি-২৪ ও টি-২১ নামে দুটি গেমিং সাইট খোলেন তারা। তারপর গুলশানে সুসজ্জিত অফিস নিয়ে সেখান থেকে এটি পরিচালনা করেন।

অনলাইন ক্যাসিনো যেভাবে পরিচালিত হতো : র‌্যাব জানায়, সেলিম ভার্চুয়াল ক্যাসিনো পরিচালনা করত। সরাসরি ক্যাসিনোতে যে ধরনের গেম পরিচালনা করা হয়, সেটিই অনলাইনে খেলা যায়।

প্রথমে একজন জুয়াড়িকে মোবাইলে টি-২১ ও পি-২৪ নামের দুটি অ্যাপস ডাউনলোড করতে হতো। পরে অ্যাপসগুলো থেকে তারা পছন্দমতো গেম বাছাই করতেন। এরপর শুরু হতো খেলা।

জিতলে টাকা জমা হতো জুয়াড়ির নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে, হারলে টাকা কাটা যেত ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, মোবাইলে অ্যাপস ডাউনলোড করার পর একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় জুয়াড়িকে। অ্যাকাউন্ট খোলার সব ধরনের ইন্সট্রাকশন বাংলাতেই দেয়া থাকে।

এছাড়া ভার্চুয়াল গেম কীভাবে খেলতে হয় সব ধরনের ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে সফটওয়্যারে। অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য প্রয়োজন হয় জুয়াড়ির মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট। মাস্টার কার্ড এবং ভিসা কার্ডের মাধ্যমেও এই অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।

তিনি আরও বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি, সেখানে ক্যাসিনোর টাকা ঢুকত। ব্যাংক হচ্ছে সিলন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি পিএলসি।

ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা সপ্তাহে একদিন সেলিমের সহযোগী আকতারুজ্জামান তুলে আরও দুটি অ্যাকাউন্টে জমা দিত।

পরে এই টাকা উত্তর কোরিয়ার লোকজন হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে নিয়ে যেত। আকতারুজ্জামান টি-২১ গেম সাইটটি পরিচালনা করত।

সুসজ্জিত অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা : গুলশান-২ নম্বরের ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় সেলিমের অফিস।

ওই অফিসে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ডে লেখা, ‘প্রধান গ্রুপ, উই আর ডিফারেন্ট।’ অফিসে প্রবেশের আগেই একটি ছোট্ট অভ্যর্থনা কক্ষ। এর বাম পাশে বড় একটি কক্ষে অনেক অফিস ডেস্ক।

কক্ষটি পার হলেই বাম পাশে সাজানো রয়েছে আসবাবপত্র। এটি অনেকটা বেডরুমের মতো। এর ডান পাশের কক্ষতেই বসতেন সেলিম প্রধান। ওই কক্ষটিও দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। র‌্যাব জানায়, এই অফিস থেকেই অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করা হতো।

এই প্রতিষ্ঠানের যারা কাজ করেন তারা সবাই সেলিমের সহযোগী হিসেবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

লন্ডনেও পাচার হতো টাকা : র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম জানান, তারেক রহমানের সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সেলিম প্রধানের।

ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে সেলিম প্রধান মামুনকে বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দেন। সেলিম লন্ডনে টাকা পাঠাতেন বলেও তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। সেখানে কার কাছে টাকা পাঠাতেন, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।

 

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

বছরে পাচার ৩২৪ কোটি টাকা

প্রকাশের সময় : ০৭:১৭:২৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অক্টোবর ২০১৯

সাজ্জাদুল ইসলাম সৌরভ ।।

অনলাইন ক্যাসিনোর আয় থেকে প্রায় ৩২৪ কোটি টাকা পাচার করেছেন সেলিম প্রধান। তিনটি ‘গেটওয়ে’র মাধ্যমে গত এক বছরে অনলাইন ক্যাসিনো গুরু এই অর্থ পাচার করেন। সেলিম বলেছেন, একটি গেটওয়ে দিয়ে মাসে পাচার করতেন প্রায় ৯ কোটি টাকা।

এই গেটওয়ে-সংক্রান্ত কাগজপত্রও র‌্যাবের হাতে এসেছে। বাকি দুটির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। এদিকে এই তিনটি গেটওয়ের বাইরে সেলিম লন্ডনেও টাকা পাচার করছেন। গ্রেফতারের পর র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে প্রাথমিকভাবে তিনি এ স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

তারেক রহমানের সহযোগী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সেলিমের ঘনিষ্ঠতা আছে। ২০০১-০৬ সালের মধ্যে তিনি মামুনকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়িও উপহার দেন। সোমবার গ্রেফতারের পর র‌্যাব তাকে অনেকটা সময় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।

এদিকে র‌্যাব সোম ও মঙ্গলবার ২০ ঘণ্টা ধরে তার দুটি অফিসে অভিযান চালিয়ে নগদ ২৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৭৭ লাখ ৬৩ হাজার টাকা সমমূল্যের ২৩ দেশের মুদ্রা, ৩২টি চেকবই, ১২টি পাসপোর্ট, ৪৮ বোতল মদ, তিনটি হরিণের চামড়া উদ্ধার করেছে।

সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে। এছাড়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

র‌্যাব জানায়, অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনার জন্য গুলশান-২ এর ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় সেলিম প্রধানের একটি অফিস আছে। এছাড়া বনানীর ২ নম্বর বোডের ১১ নম্বর বাড়ির ষষ্ঠ তলায়ও তার আরও একটি অফিস আছে।

সোমবার রাত ৮ থেকে র‌্যাব তাকে সঙ্গে নিয়ে দুটি অফিসেই অভিযান চালায়। মঙ্গলবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত অভিযান চলে। অভিযান শেষে মঙ্গলবার বিকালে গুলশান-২ এর বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম।

তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু’র পরামর্শে বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনোর ব্যবসা শুরু করে সেলিম প্রধান। সব ধরনের কারিগরি সহায়তাও দেয় মি. দু। ব্যবসার অর্ধেক অংশীদারও উত্তর কোরিয়ার এই নাগরিক। এই ব্যবসা থেকে আয়ের অধিকাংশ অর্থই বিদেশে পাচার হয়েছে।

একটি ‘গেটওয়ে’ থেকেই মাসে পাচার হতো প্রায় ৯ কোটি টাকা। এরকম তিনটি ‘গেটওয়ে’র বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনটি গেটওয়ে দিয়ে এক বছর ধরে ক্যাসিনোর টাকা পাচার করছে।

আরও গেটওয়ে আছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। র‌্যাবের অপর এক সূত্র জানায়, তিন গেটওয়ে দিয়ে সেলিম মাসে ২৭ কোটি এবং বছরে ৩২৪ কোটি টাকা পাচার করেছে।

সোমবার সেলিম প্রধানকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে গ্রেফতার করে নামিয়ে আনা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযানে নামে র‌্যাব।

এতে দেশি-বিদেশি টাকা, মদসহ অনলাইন গেমিংয়ের ডাটা সংরক্ষণের কম্পিউটার, চারটি ল্যাপটপ উদ্ধার করা হয়। পরে বনানীর একটি বাসায় সেলিমের আরেকটি অফিসে অভিযান চালিয়ে নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়।

অভিযানে সেলিমের দুই সহযোগী আক্তারুজ্জামান এবং মো. রোমানকে গ্রেফতার করা হয়।

অভিযানের বিষয়ে র‌্যাব-১’র অধিনায়ক বলেন, আমাদের একটি অনলাইন মনিটরিং সেল রয়েছে। ওই টিম দেখতে পায়, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বাংলাদেশে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনা করছে।

তারপর এই চক্রকে ধরতে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। গোপন খবরের ভিত্তিতে সোমবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর বাংলাদেশ প্রধান ও সমন্বয়ক সেলিম প্রধানকে।

তিনি থাই এয়ারওয়েজের ব্যাংককগামী একটি ফ্লাইটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান-২ নম্বরে তার অফিসে অভিযান পরিচালনা করা হয়।

তার অফিস থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাগজ-পত্রও পরীক্ষা করে দেখা যায়, এই ব্যবসাটি সেলিম কোরীয় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পরিচালনা করছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধান।

এই ব্যবসার ৫০ শতাংশের মালিকানা তার এবং বাকি ৫০ শতাংশের অংশীদার উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু।

সেলিম যেভাবে ক্যাসিনো ব্যবসায় : র‌্যাব জানায়, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় সেলিমের জন্ম। ১৯৮৮ সালে তিনি জাপানে যান। সেখানে গিয়ে জাপানিদের সঙ্গে মিলে গাড়ি ব্যবসায় নাম লেখান।

পরে জাপানিদের সঙ্গেই পার্টনারশিপে থাইল্যান্ডে শিপইয়ার্ডের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। জাপানিদের মাধ্যমেই উত্তর কোরিয়ার নাগরিক মি. দু’র সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মি. দু বাংলাদেশে কনস্ট্রাকশন ব্যবসায় আগ্রহ প্রকাশ করেন।

ধীরে ধীরে সেলিমের সঙ্গে সখ্য বাড়ার পর মি. দু তাকে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসার পরিকল্পনার কথা বলেন। ২০১৮ সালে মি. দু এবং সেলিম অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন।

পি-২৪ ও টি-২১ নামে দুটি গেমিং সাইট খোলেন তারা। তারপর গুলশানে সুসজ্জিত অফিস নিয়ে সেখান থেকে এটি পরিচালনা করেন।

অনলাইন ক্যাসিনো যেভাবে পরিচালিত হতো : র‌্যাব জানায়, সেলিম ভার্চুয়াল ক্যাসিনো পরিচালনা করত। সরাসরি ক্যাসিনোতে যে ধরনের গেম পরিচালনা করা হয়, সেটিই অনলাইনে খেলা যায়।

প্রথমে একজন জুয়াড়িকে মোবাইলে টি-২১ ও পি-২৪ নামের দুটি অ্যাপস ডাউনলোড করতে হতো। পরে অ্যাপসগুলো থেকে তারা পছন্দমতো গেম বাছাই করতেন। এরপর শুরু হতো খেলা।

জিতলে টাকা জমা হতো জুয়াড়ির নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে, হারলে টাকা কাটা যেত ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, মোবাইলে অ্যাপস ডাউনলোড করার পর একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় জুয়াড়িকে। অ্যাকাউন্ট খোলার সব ধরনের ইন্সট্রাকশন বাংলাতেই দেয়া থাকে।

এছাড়া ভার্চুয়াল গেম কীভাবে খেলতে হয় সব ধরনের ইন্সট্রাকশন দেয়া আছে সফটওয়্যারে। অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য প্রয়োজন হয় জুয়াড়ির মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট। মাস্টার কার্ড এবং ভিসা কার্ডের মাধ্যমেও এই অ্যাকাউন্ট খোলা যায়।

তিনি আরও বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত দুটি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি, সেখানে ক্যাসিনোর টাকা ঢুকত। ব্যাংক হচ্ছে সিলন ব্যাংক, যমুনা ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি পিএলসি।

ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা হওয়া টাকা সপ্তাহে একদিন সেলিমের সহযোগী আকতারুজ্জামান তুলে আরও দুটি অ্যাকাউন্টে জমা দিত।

পরে এই টাকা উত্তর কোরিয়ার লোকজন হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে দেশের বাইরে নিয়ে যেত। আকতারুজ্জামান টি-২১ গেম সাইটটি পরিচালনা করত।

সুসজ্জিত অফিস থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা : গুলশান-২ নম্বরের ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলায় সেলিমের অফিস।

ওই অফিসে ঢুকতেই চোখে পড়বে একটি সাইনবোর্ডে লেখা, ‘প্রধান গ্রুপ, উই আর ডিফারেন্ট।’ অফিসে প্রবেশের আগেই একটি ছোট্ট অভ্যর্থনা কক্ষ। এর বাম পাশে বড় একটি কক্ষে অনেক অফিস ডেস্ক।

কক্ষটি পার হলেই বাম পাশে সাজানো রয়েছে আসবাবপত্র। এটি অনেকটা বেডরুমের মতো। এর ডান পাশের কক্ষতেই বসতেন সেলিম প্রধান। ওই কক্ষটিও দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। র‌্যাব জানায়, এই অফিস থেকেই অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করা হতো।

এই প্রতিষ্ঠানের যারা কাজ করেন তারা সবাই সেলিমের সহযোগী হিসেবে ক্যাসিনো ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

লন্ডনেও পাচার হতো টাকা : র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম জানান, তারেক রহমানের সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল সেলিম প্রধানের।

ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে সেলিম প্রধান মামুনকে বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার দেন। সেলিম লন্ডনে টাকা পাঠাতেন বলেও তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। সেখানে কার কাছে টাকা পাঠাতেন, সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।