শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সন্দেহের বশে এ কেমন হত্যা?

জহিরুল ইসলাম রিপন :- 

সন্দেহে হত্যা। পিটিয়ে। এ নজির তো আমরা দেখেছি কদিন আগে। পথে পথে। মাথাকাটা বা ছেলেধরা অপবাদে। যাচাই-বাছাই করার আগেই, প্রাণ গেছে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবা কিংবা তরুণের। পরে জানা গেছে, তাদের দোষ ছিল না। লোকে বলেছে, পথেঘাটে এ মূর্খ বর্বরদের কাজ। ওরা মানুষ নয়। জ্ঞানের আলো নেই ওদের কাছে। ওরা অন্ধ।

কিন্তু এখন? এখন কী বলবেন? যখন বুয়েটের ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হয়, ‘শিবির সন্দেহে’? এখনো কি বলবেন, এটি পথঘাটের মূর্খ বর্বরদের কাজ? নাকি জ্ঞানের আলো নেই ওদের কাছে?

ছেলেটির নাম আবরার ফাহাদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো। থাকতো শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুমে।

হলনিবাসীরা বলেছেন, ‘শিবির সন্দেহে আবরারকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের দিকে।

বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা অবশ্য গণমাধ্যমে বলেছেনও, তারা আবরারকে ডেকে নিয়েছিলেন হলের ২০১১ নম্বর ঘরে। তারপর তার মুঠোফোনে ফেসবুক, মেসেঞ্জার চেক করা হয়। ‘বিতর্কিত’ কিছু পেইজে লাইক দেওয়ার প্রমাণ পায়। কয়েকজনের সঙ্গে তার খুদেবার্তা চালাচালিতে প্রমাণ হয়েছে সে শিবির করতো।

তারপরে চলে নির্যাতন। রবিবার রাত তিনটার দিকে বুয়েটের চিকিৎসক ডা. মাসুক এলাহী ফোন পান। এসে দেখেন, ছেলেটিকে সিঁড়ির কাছে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ততক্ষণে প্রাণহীন নিথর দেহ।

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটু ভিন্ন চোখেই দেখে দেশের মানুষ। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভাগ্যেই জোটে বুয়েটের পাঠ। তারা শুধু দেশ নয়, বিশ্বের সম্পদ। সৃষ্টি আর আবিষ্কারের নেশা তাদের মননে। তারা আপন আলোয় আলোকিত করে দেশকে, দেশের মানুষকে। উন্নয়ন, সমৃদ্ধির সঙ্গে তাদের নামটি লেখা সোনালী হরফে। কিন্তু তারাও যখন কেবল ‘সন্দেহে’ একটি প্রাণ কেড়ে নেন, তখন কী বলা যায়?

ছেলেটির অপরাধ থাকতে পারে। অপরাধের শাস্তিও হতে পারতো। কিন্তু এভাবে? ভয়ংকর খুনিদেরও বিচার হয়। আইন আছে। আছে আদালত। বিচারব্যবস্থা। ধরে নিলাম ছেলেটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। তাকে পুলিশে দেওয়া যেতো। আইন তার বিচার করতো। অথবা জানাতে পারতো হল কর্তৃপক্ষকে। বের করে দেওয়া যেতো হল থেকে। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চিরকালের মতো বহিষ্কার করা যেতো। কত পথই তো খোলা ছিল।  তারপরও কেন তাকে পিটিয়ে মারতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ দেবেন?

গণমাধ্যমের খবরে এসেছে নিহত আবরারের মামাতো ভাই একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক। আবু তালহা রাসেল ৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবরারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা একদমই সত্য নয়। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগের পাঁচজন সমর্থক থাকলে তার বাবা বরকতউল্লাহ তাদের একজন। আমরা এই হত্যার বিচার চাই৷’

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে,  কুষ্টিয়ার পিটিআই সড়কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাসার পাশেই আবরারদের বাড়ি।

আবরারের চাচা মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, ‘সে শিবিরের কর্মী, এমন কথা রটাচ্ছে সবাই। এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের বিভিন্ন মিটিংয়েও আমরা যাই।’

প্রশ্ন হচ্ছে, কারা ঠিক? বুয়েট ছাত্রলীগ নাকি আবরারের পরিবার? এই সিদ্ধান্তে আসার আগে প্রয়োজন খুনিদের গ্রেপ্তার করা। কেউ যেন রেহাই না পায়। এমন নির্মম কাজ যারা করতে পারে, তারা বিদ্যাবুদ্ধিতে যতই সমৃদ্ধ হোক, যতই মেধাবী হোক, পথেঘাটের মূর্খ বর্বরদের চেয়েও তারা জঘন্য। জ্ঞান যাদের মনে আলো জ্বালতে পারে না, তারা আজন্ম অন্ধ।

আবরারের কুষ্টিয়ার বাড়িতে এখন শোকের মাতম। মা কাঁদছে। বাবা কাঁদছে। ভাইয়ের মৃত্যুতে কাঁদছেই ভাই। এই শোক সইবে কি প্রিয়জনের?

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

সন্দেহের বশে এ কেমন হত্যা?

প্রকাশের সময় : ০২:৪০:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০১৯
জহিরুল ইসলাম রিপন :- 

সন্দেহে হত্যা। পিটিয়ে। এ নজির তো আমরা দেখেছি কদিন আগে। পথে পথে। মাথাকাটা বা ছেলেধরা অপবাদে। যাচাই-বাছাই করার আগেই, প্রাণ গেছে। নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, যুবা কিংবা তরুণের। পরে জানা গেছে, তাদের দোষ ছিল না। লোকে বলেছে, পথেঘাটে এ মূর্খ বর্বরদের কাজ। ওরা মানুষ নয়। জ্ঞানের আলো নেই ওদের কাছে। ওরা অন্ধ।

কিন্তু এখন? এখন কী বলবেন? যখন বুয়েটের ছাত্রকে পিটিয়ে মারা হয়, ‘শিবির সন্দেহে’? এখনো কি বলবেন, এটি পথঘাটের মূর্খ বর্বরদের কাজ? নাকি জ্ঞানের আলো নেই ওদের কাছে?

ছেলেটির নাম আবরার ফাহাদ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়তো। থাকতো শেরে বাংলা হলের ১০১১ নম্বর রুমে।

হলনিবাসীরা বলেছেন, ‘শিবির সন্দেহে আবরারকে স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে। অভিযোগের আঙুল বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাদের দিকে।

বুয়েট ছাত্রলীগের এক নেতা অবশ্য গণমাধ্যমে বলেছেনও, তারা আবরারকে ডেকে নিয়েছিলেন হলের ২০১১ নম্বর ঘরে। তারপর তার মুঠোফোনে ফেসবুক, মেসেঞ্জার চেক করা হয়। ‘বিতর্কিত’ কিছু পেইজে লাইক দেওয়ার প্রমাণ পায়। কয়েকজনের সঙ্গে তার খুদেবার্তা চালাচালিতে প্রমাণ হয়েছে সে শিবির করতো।

তারপরে চলে নির্যাতন। রবিবার রাত তিনটার দিকে বুয়েটের চিকিৎসক ডা. মাসুক এলাহী ফোন পান। এসে দেখেন, ছেলেটিকে সিঁড়ির কাছে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ততক্ষণে প্রাণহীন নিথর দেহ।

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের একটু ভিন্ন চোখেই দেখে দেশের মানুষ। দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভাগ্যেই জোটে বুয়েটের পাঠ। তারা শুধু দেশ নয়, বিশ্বের সম্পদ। সৃষ্টি আর আবিষ্কারের নেশা তাদের মননে। তারা আপন আলোয় আলোকিত করে দেশকে, দেশের মানুষকে। উন্নয়ন, সমৃদ্ধির সঙ্গে তাদের নামটি লেখা সোনালী হরফে। কিন্তু তারাও যখন কেবল ‘সন্দেহে’ একটি প্রাণ কেড়ে নেন, তখন কী বলা যায়?

ছেলেটির অপরাধ থাকতে পারে। অপরাধের শাস্তিও হতে পারতো। কিন্তু এভাবে? ভয়ংকর খুনিদেরও বিচার হয়। আইন আছে। আছে আদালত। বিচারব্যবস্থা। ধরে নিলাম ছেলেটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। তাকে পুলিশে দেওয়া যেতো। আইন তার বিচার করতো। অথবা জানাতে পারতো হল কর্তৃপক্ষকে। বের করে দেওয়া যেতো হল থেকে। কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই চিরকালের মতো বহিষ্কার করা যেতো। কত পথই তো খোলা ছিল।  তারপরও কেন তাকে পিটিয়ে মারতে হলো? এই প্রশ্নের উত্তর কি কেউ দেবেন?

গণমাধ্যমের খবরে এসেছে নিহত আবরারের মামাতো ভাই একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক। আবু তালহা রাসেল ৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আবরারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা একদমই সত্য নয়। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নে। আওয়ামী লীগের পাঁচজন সমর্থক থাকলে তার বাবা বরকতউল্লাহ তাদের একজন। আমরা এই হত্যার বিচার চাই৷’

গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে,  কুষ্টিয়ার পিটিআই সড়কে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাসার পাশেই আবরারদের বাড়ি।

আবরারের চাচা মিজানুর রহমান দাবি করেছেন, ‘সে শিবিরের কর্মী, এমন কথা রটাচ্ছে সবাই। এটা বানোয়াট, আমরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক। হানিফ সাহেবের বিভিন্ন মিটিংয়েও আমরা যাই।’

প্রশ্ন হচ্ছে, কারা ঠিক? বুয়েট ছাত্রলীগ নাকি আবরারের পরিবার? এই সিদ্ধান্তে আসার আগে প্রয়োজন খুনিদের গ্রেপ্তার করা। কেউ যেন রেহাই না পায়। এমন নির্মম কাজ যারা করতে পারে, তারা বিদ্যাবুদ্ধিতে যতই সমৃদ্ধ হোক, যতই মেধাবী হোক, পথেঘাটের মূর্খ বর্বরদের চেয়েও তারা জঘন্য। জ্ঞান যাদের মনে আলো জ্বালতে পারে না, তারা আজন্ম অন্ধ।

আবরারের কুষ্টিয়ার বাড়িতে এখন শোকের মাতম। মা কাঁদছে। বাবা কাঁদছে। ভাইয়ের মৃত্যুতে কাঁদছেই ভাই। এই শোক সইবে কি প্রিয়জনের?