বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ছিটমহল বাসির জীবন মান

মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাফা : লালমনিরহাট :=

লালমনিরহাট জেলায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহল বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। পেয়েছে নাগরিক অধিকার ও আইনি সুরক্ষা।
৪ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলে মানুষ গুলো দেশের মূলভূখন্ডের মানুষের মূলধারায় যুক্ত হয়ে গেছে। ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়নের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছালেহা সরকার বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি সরকারি করার দাবি জানিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দাবি উঠেছে একটি কমুনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্টার।

দাবি উঠেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমি সংক্রান্ত সকল জঠিলতা নিরসন করার। যাতে বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির মালিকরা বিলুপ্ত ছিটমহলের জমি ক্রয় বিক্রয় করতে পারে।২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ভিতরে থাকা ছিটমহল গুলো বিনিময়ের ফলে ৬৮ বছরের পরাধীনতার শিঁকল ভেঙ্গে মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ গুলো পেয়েছে স্বাধীনতা। পেয়েছে দেশের নাগরিকত্ব। পেয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসারমত মৌলিক অধিকার। শিশু ও নারীরা পেয়েছে পর্যাদাপূর্ণজীবন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা এখন দেশের মূলভূখন্ডের নাগরিকদেরমত সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। মিশে গেছে দেশের মূলস্রোতধারায়। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্র উন্নয়ন চোখে পড়ে। বিলুপ্ত ছিটমহলে এখন ঝুঁপড়ি ঘর নেই। কাঁচাপাকা টিনসেড বাড়ি ঘর চোখে পড়ে। মানুষের আর্থসামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা।

নারী ও শিশুরা পেয়েছে আইনের সুরক্ষা। শিশু ও নারী অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদের সুত্রে জানা গেছে, বিগত ৪ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমলের উন্নয়নে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা সদরের ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ও বোয়ালমারী বাঁশ পঁচাই সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দুইটিতে বিগত ৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে বিলুপ্ত ছিটমহল ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাইয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন। এই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ২২৭টি পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে ৪টি পরিবার রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের । এই বিলুপ্তছিটমহলের মানুষ ভারতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও কোন মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নেয়নি। ভারতে যায়নি। ছিটমহলটির আয়তন প্রায় ৮৫ বর্গ একর জমি। এই বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি ও কৃষি শ্রমিক।

বিলুপ্ত ছিটমহলটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধরলা নদী। তাই কিছু মানুষ ধরলা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা মৎসজীবি শ্রমিক। ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ছিটমহলটিতে বিগত ৪ বছরে শহীদ মিনার, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাঁও মাঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তা পাঁকা হয়েছে এলজিইডির অধিনে প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌচ্ছে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ একশত ওয়ার্ডের সোলার প্যানেল সরকারি ভাবে দেয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবারকে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলতা ফিরাতে বিগত দুই বছর সরকারি ভাবে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে ভিজিডি কার্ডের মাধ্যকে বিনামূল্যে চাল দেয়া হয়ে ছিল। সরকারি ভাবে ল্যাট্রিন, টিউবয়েল, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্দিভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড দেয়া হয়েছে। কৃষকদের সহায়তা করতে ও স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা দিতে ১টি সৌরবিদ্যূৎ চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলটিতে বিগত ৪ বছরে প্রায় ৩শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে।ছিটমহল বিনিময়ের পূর্বে ছিটের শিশু ও নারীদের আইনের মাধ্যমে কোন সুরক্ষা ছিলনা। এখানে ছিলনা আইনের শাসন।

ছিটমহলের নারীদের বিয়ে হলে কোন নিকা রেজিষ্ট্রি হতো না। তাই স্বামী দ্বারা তারা নির্যাতন ও তালাক প্রাপ্ত হলে কোন আইনি সহায়তা পেত না। নারী শিশুরা পাচার বা অপহরণ হলে কোন আইনি সহায়তা পেতনা। ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিল অবহেলিত। অন্যের জমিতে স্বল্পমূল্যে শ্রম ও দিনমজুরী করে জীবন চলত। সেখানে নির্যাতন হলেও ছিটমহলের অধিবাসী বলে কোন বিচার পেত না। ছিটমহলের কৃষক তার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের কোন ন্যায্য মূল্য পেতনা। ছিটমহলের চাষীরা পুরনো পদ্দতিতে করতো চাষাবাদ। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষেরা আধুনিক কৃষি যন্ত্র ও আধুনিক পদ্দতিতে চাষাবাদ করছে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পন্য ন্যায়মূল্যে দেশের মূলভূখন্ডের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ এখন সরকারি ভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। পাচ্ছে দেশের মূলভূখন্ডে মানুষেরমত সকল সুযোগ সুবিধা।ভিতরকুটি বাঁশ পচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলটি হতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দূরত্ব প্রায় ২/৩ কিলোমিটার। তাই ২০১৫ সালে ভিতরকুটি ছিটমহলে লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোঃ মতিয়ার রহমান ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪৫ শতাংশ জমি কিনে তার মায়ের নামে ছালেহা সরকার বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেনিতে ৩৫ জন, প্রথম শ্রেনিতে ২০ জন, দ্বিতীয় শ্রেনিতে ২২জন, তৃতীয় শ্রেনিতে ১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেনিতে ১০জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, ৪জন নারী সহকারি শিক্ষিকা ও একজন সহকারি শিক্ষক রয়েছে। তারা দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বিনা বেতনে স্কুলটিতে পাঠদান করে আসছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছা শিরিনা খাতুন জানান, বিদ্যালয়টির শিশু শিক্ষার্থীরা কোন সরকারি উপবৃত্তি পায় না।

তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। সরকারি উপবৃত্তি পাশ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালূ রয়েছে। সেখানে উপবৃত্তির কারনে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে শিক্ষা গ্রহন করছে। ছালেহা সরকার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি চালু না থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম বলে জানান। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, বই খাতা ও টিফিন বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা দিয়ে থাকেন। বিদ্যালয়ে ব্র্যাঞ্চ সংখ্যাও কম রয়েছে। বিদ্যালয়টি দ্রুত জাতীয়করণ করে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতে দাবি জানান। বিগত ৪ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে বিভিন্ন দপ্তর নানা প্রশিক্ষন দিয়েছেন। ট্রেনিং পেয়েছেন ভিডিপি, আইটি, কৃষি, ব্র্যাক, পশুপালন, মৎস্যচাষ, গরু ছাগল পালন, ভেড়া পালন, হাঁসমুরগি পালন। কৃষকরা উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে মাধ্যমে আধুনিক চাষাবাদের নানা পরামর্শ পেয়ে থাকেন।
বিলুপ্ত বাঁশ পচাই ছিটমহলের বাসিন্দারা বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ১টি কমুনিটি ক্লিনিক স্থাপনের। এছাড়া বেকারদের কর্মসংখ্যান ও শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুবমহিলাদের মেধা ও শিক্ষানুযায়ী চাকুরির দাবি জানান। ভিতরকুটি বাঁশপচাই বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, বিলুপ্ত ছিটমহল মুক্ত হওয়ার ৪ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ তাদের বাড়ি ঘর জমির খাজনা দিতে পারছেনা। তাই বিলূপ্ত ছিটমহলবাসিরা তাদের কৃষি জমি ক্রয় বিক্্রয় করতে পারছেনা। জমি ক্রয় বিক্রয় করা সংক্রান্ত জঠিলতার তারা দ্রুত নিষ্পত্তি চান। কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের ধাইরখাতা ও বনগ্রাম মৌজার অভ্যন্তরে ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ও বয়ালমারী বাঁশ পঁচাই বিলুপ্ত ছিটমহল দু’টির অবস্থান। তাই কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলে বিগত ৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আরো উন্নয়ন হবে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষরা দেশের মূলভূখন্ডের মূল স্রোতধারার মিশে গেছে। বিলূপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবার এখন মোটামুটি আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে।৬৮ বছর নিজ দেশে পরবাসী ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ। ছিল উন্নয়ন বঞ্চিত । ছিলনা কোন দেশের নাগরিক অধিকার। বিলুপ্ত ছিটমহল গুলো ছিল অবহেলিত। ছিল না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছিলনা রাস্তা ঘাট। ছিলনা ধর্মীয় উপাসনালয়, মসজিদ, মন্দির। ছিটমহল গুলোর বাসিন্দারা ৬৮ বছর ছিল পরিচয়হীন। পরগাছারমত বেঁচে ছিল। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসারমত মৌলিক অধিকার হতে ছিল সর্ম্পূন বঞ্চিত। ছিটমহলে ছিলনা কোন আইন। দু’দেশের কোন দেশের প্রশাসন ওআইনশৃংখলাবাহিনীর কোন তদরকি ছিলমহলে ছিল না। তাই ছিটমহলে অপরাধীদের ছিল আশ্রয় স্থল। ছিটমহলের শিশুরা বেড়ে উঠতো অপরাধ প্রবনতা নিয়ে। ছিটমহলের নারীরা ছিল প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীদের ভোগের পাত্রী। ছিটমহলে নারীদের বিয়েসাধি হলে কোন নিকা রেজিষ্ট্রি হতো না।

তাই নারীরা স্বামীর সংসারের নির্যাতনের শিকার হলে কোন বিচারপ্রাথী হতে পারতোনা। ছিটমহল বিনিময়ে সেইদিন শেষ হয়ে গেছে। এখন নারী ও শিশুরা আইনের দ্বারা সুরক্ষিত।লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানান, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা মুজিব সীমান্ত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের ভিতরে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় ৪টি। যার জমির পরিমাণ প্রায় ১৭হাজার ১শত ৬০একর। জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ৪শত ৪৯ জন। এর মধ্যে ৯৭৯ জন ভারতীয় নাগরিক হয়ে ভারতে চলে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১৯টি ছিলমহলে কোন জনসংখ্যা ছিলনা। শুধু কৃষি জমি ছিল।

ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের কোন বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত হতে বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের কুচবিহার জেলার ভিতর ছিল। ৫১টি ছিটমহলের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার । জমির পরিমান ৭ হাজার একর। লালমনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসক মোঃ আবু জাফর জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। এখন বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর মানুষ দেশের সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের সকল সমস্যা একে একে দূরকরা হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে গেছে ছিটমহল বাসির জীবন মান

প্রকাশের সময় : ০৭:৩০:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০১৯

মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাফা : লালমনিরহাট :=

লালমনিরহাট জেলায় বদলে গেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের চিত্র। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহল বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারে এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা। শিশু ও নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত হয়েছে। পেয়েছে নাগরিক অধিকার ও আইনি সুরক্ষা।
৪ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত ছিটমহলে মানুষ গুলো দেশের মূলভূখন্ডের মানুষের মূলধারায় যুক্ত হয়ে গেছে। ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। সর্বত্র উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়নের ভিতরকুটি বাঁশপচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ছালেহা সরকার বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি সরকারি করার দাবি জানিয়েছে বিলুপ্ত ছিটমহলবাসী। প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে দাবি উঠেছে একটি কমুনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্টার।

দাবি উঠেছে বিলুপ্ত ছিটমহলের ভূমি সংক্রান্ত সকল জঠিলতা নিরসন করার। যাতে বিলুপ্ত ছিটমহলের জমির মালিকরা বিলুপ্ত ছিটমহলের জমি ক্রয় বিক্রয় করতে পারে।২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের ভিতরে থাকা ছিটমহল গুলো বিনিময়ের ফলে ৬৮ বছরের পরাধীনতার শিঁকল ভেঙ্গে মুক্ত হয়ে যায়। মানুষ গুলো পেয়েছে স্বাধীনতা। পেয়েছে দেশের নাগরিকত্ব। পেয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসারমত মৌলিক অধিকার। শিশু ও নারীরা পেয়েছে পর্যাদাপূর্ণজীবন। বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা এখন দেশের মূলভূখন্ডের নাগরিকদেরমত সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। মিশে গেছে দেশের মূলস্রোতধারায়। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের সর্বত্র উন্নয়ন চোখে পড়ে। বিলুপ্ত ছিটমহলে এখন ঝুঁপড়ি ঘর নেই। কাঁচাপাকা টিনসেড বাড়ি ঘর চোখে পড়ে। মানুষের আর্থসামাজিক মর্যাদা বেড়েছে। এসেছে আর্থিক স্বচ্ছলতা।

নারী ও শিশুরা পেয়েছে আইনের সুরক্ষা। শিশু ও নারী অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।লালমনিরহাট জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদের সুত্রে জানা গেছে, বিগত ৪ বছরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমলের উন্নয়নে প্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার কাজ হয়েছে। লালমনিরহাট জেলা সদরের ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ও বোয়ালমারী বাঁশ পঁচাই সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহল দুইটিতে বিগত ৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে বিলুপ্ত ছিটমহল ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাইয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন। এই বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ২২৭টি পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে ৪টি পরিবার রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের । এই বিলুপ্তছিটমহলের মানুষ ভারতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েও কোন মানুষ ভারতের নাগরিকত্ব নেয়নি। ভারতে যায়নি। ছিটমহলটির আয়তন প্রায় ৮৫ বর্গ একর জমি। এই বিলুপ্ত ছিটমহলের অধিকাংশ মানুষের পেশা কৃষি ও কৃষি শ্রমিক।

বিলুপ্ত ছিটমহলটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধরলা নদী। তাই কিছু মানুষ ধরলা নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা মৎসজীবি শ্রমিক। ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ছিটমহলটিতে বিগত ৪ বছরে শহীদ মিনার, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাঁও মাঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তা পাঁকা হয়েছে এলজিইডির অধিনে প্রায় ৯ কিলোমিটার। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ বিদ্যুৎ পৌচ্ছে গেছে। প্রতিটি বাড়িতে শতভাগ একশত ওয়ার্ডের সোলার প্যানেল সরকারি ভাবে দেয়া হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবারকে আর্থিক ভাবে স্বচ্ছলতা ফিরাতে বিগত দুই বছর সরকারি ভাবে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে ভিজিডি কার্ডের মাধ্যকে বিনামূল্যে চাল দেয়া হয়ে ছিল। সরকারি ভাবে ল্যাট্রিন, টিউবয়েল, ভিজিডি কার্ড, বয়স্কভাতা, প্রতিবন্দিভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড দেয়া হয়েছে। কৃষকদের সহায়তা করতে ও স্বল্পমূল্যে সেচ সুবিধা দিতে ১টি সৌরবিদ্যূৎ চালিত সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। বিলুপ্ত ছিটমহলটিতে বিগত ৪ বছরে প্রায় ৩শত কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে।ছিটমহল বিনিময়ের পূর্বে ছিটের শিশু ও নারীদের আইনের মাধ্যমে কোন সুরক্ষা ছিলনা। এখানে ছিলনা আইনের শাসন।

ছিটমহলের নারীদের বিয়ে হলে কোন নিকা রেজিষ্ট্রি হতো না। তাই স্বামী দ্বারা তারা নির্যাতন ও তালাক প্রাপ্ত হলে কোন আইনি সহায়তা পেত না। নারী শিশুরা পাচার বা অপহরণ হলে কোন আইনি সহায়তা পেতনা। ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিল অবহেলিত। অন্যের জমিতে স্বল্পমূল্যে শ্রম ও দিনমজুরী করে জীবন চলত। সেখানে নির্যাতন হলেও ছিটমহলের অধিবাসী বলে কোন বিচার পেত না। ছিটমহলের কৃষক তার উৎপাদিত কৃষি পণ্যের কোন ন্যায্য মূল্য পেতনা। ছিটমহলের চাষীরা পুরনো পদ্দতিতে করতো চাষাবাদ। এখন বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষেরা আধুনিক কৃষি যন্ত্র ও আধুনিক পদ্দতিতে চাষাবাদ করছে। তাদের উৎপাদিত কৃষি পন্য ন্যায়মূল্যে দেশের মূলভূখন্ডের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারছে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ এখন সরকারি ভাবে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। পাচ্ছে দেশের মূলভূখন্ডে মানুষেরমত সকল সুযোগ সুবিধা।ভিতরকুটি বাঁশ পচাঁই বিলুপ্ত ছিটমহলটি হতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দূরত্ব প্রায় ২/৩ কিলোমিটার। তাই ২০১৫ সালে ভিতরকুটি ছিটমহলে লালমনিরহাট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট মোঃ মতিয়ার রহমান ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৪৫ শতাংশ জমি কিনে তার মায়ের নামে ছালেহা সরকার বে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। বিদ্যালয়টিতে শিশু শ্রেনিতে ৩৫ জন, প্রথম শ্রেনিতে ২০ জন, দ্বিতীয় শ্রেনিতে ২২জন, তৃতীয় শ্রেনিতে ১৫ জন ও চতুর্থ শ্রেনিতে ১০জন শিশু শিক্ষার্থী রয়েছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, ৪জন নারী সহকারি শিক্ষিকা ও একজন সহকারি শিক্ষক রয়েছে। তারা দীর্ঘ ৪ বছর ধরে বিনা বেতনে স্কুলটিতে পাঠদান করে আসছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোছা শিরিনা খাতুন জানান, বিদ্যালয়টির শিশু শিক্ষার্থীরা কোন সরকারি উপবৃত্তি পায় না।

তাই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। সরকারি উপবৃত্তি পাশ্ববর্তী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালূ রয়েছে। সেখানে উপবৃত্তির কারনে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে শিক্ষা গ্রহন করছে। ছালেহা সরকার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপবৃত্তি চালু না থাকা শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম বলে জানান। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপকরণ, বই খাতা ও টিফিন বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা দিয়ে থাকেন। বিদ্যালয়ে ব্র্যাঞ্চ সংখ্যাও কম রয়েছে। বিদ্যালয়টি দ্রুত জাতীয়করণ করে বিলুপ্ত ছিটমহলের শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিশ্চিতে দাবি জানান। বিগত ৪ বছরে বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে বিভিন্ন দপ্তর নানা প্রশিক্ষন দিয়েছেন। ট্রেনিং পেয়েছেন ভিডিপি, আইটি, কৃষি, ব্র্যাক, পশুপালন, মৎস্যচাষ, গরু ছাগল পালন, ভেড়া পালন, হাঁসমুরগি পালন। কৃষকরা উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে মাধ্যমে আধুনিক চাষাবাদের নানা পরামর্শ পেয়ে থাকেন।
বিলুপ্ত বাঁশ পচাই ছিটমহলের বাসিন্দারা বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ১টি কমুনিটি ক্লিনিক স্থাপনের। এছাড়া বেকারদের কর্মসংখ্যান ও শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ও যুবমহিলাদের মেধা ও শিক্ষানুযায়ী চাকুরির দাবি জানান। ভিতরকুটি বাঁশপচাই বিলুপ্ত ছিটমহল উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মোঃ হারুন অর রশিদ জানান, বিলুপ্ত ছিটমহল মুক্ত হওয়ার ৪ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষ তাদের বাড়ি ঘর জমির খাজনা দিতে পারছেনা। তাই বিলূপ্ত ছিটমহলবাসিরা তাদের কৃষি জমি ক্রয় বিক্্রয় করতে পারছেনা। জমি ক্রয় বিক্রয় করা সংক্রান্ত জঠিলতার তারা দ্রুত নিষ্পত্তি চান। কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের ধাইরখাতা ও বনগ্রাম মৌজার অভ্যন্তরে ভিতরকুটি বাঁশ পঁচাই ও বয়ালমারী বাঁশ পঁচাই বিলুপ্ত ছিটমহল দু’টির অবস্থান। তাই কুলাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ ইদ্রিস আলী জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলে বিগত ৪ বছরে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। আরো উন্নয়ন হবে।

বিলুপ্ত ছিটমহলের মানুষরা দেশের মূলভূখন্ডের মূল স্রোতধারার মিশে গেছে। বিলূপ্ত ছিটমহলের প্রতিটি পরিবার এখন মোটামুটি আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে পেয়েছে।৬৮ বছর নিজ দেশে পরবাসী ছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা ১৬২টি ছিটমহলের মানুষ। ছিল উন্নয়ন বঞ্চিত । ছিলনা কোন দেশের নাগরিক অধিকার। বিলুপ্ত ছিটমহল গুলো ছিল অবহেলিত। ছিল না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছিলনা রাস্তা ঘাট। ছিলনা ধর্মীয় উপাসনালয়, মসজিদ, মন্দির। ছিটমহল গুলোর বাসিন্দারা ৬৮ বছর ছিল পরিচয়হীন। পরগাছারমত বেঁচে ছিল। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসারমত মৌলিক অধিকার হতে ছিল সর্ম্পূন বঞ্চিত। ছিটমহলে ছিলনা কোন আইন। দু’দেশের কোন দেশের প্রশাসন ওআইনশৃংখলাবাহিনীর কোন তদরকি ছিলমহলে ছিল না। তাই ছিটমহলে অপরাধীদের ছিল আশ্রয় স্থল। ছিটমহলের শিশুরা বেড়ে উঠতো অপরাধ প্রবনতা নিয়ে। ছিটমহলের নারীরা ছিল প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসীদের ভোগের পাত্রী। ছিটমহলে নারীদের বিয়েসাধি হলে কোন নিকা রেজিষ্ট্রি হতো না।

তাই নারীরা স্বামীর সংসারের নির্যাতনের শিকার হলে কোন বিচারপ্রাথী হতে পারতোনা। ছিটমহল বিনিময়ে সেইদিন শেষ হয়ে গেছে। এখন নারী ও শিশুরা আইনের দ্বারা সুরক্ষিত।লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানান, ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা মুজিব সীমান্ত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশ ও ভারতের ভিতরে থাকা ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় চুক্তি ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্য রাতে বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহল পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার। এগুলোর মধ্যে লালমনিরহাট জেলায় ৫৯টি, পঞ্চগড় জেলায় ৩৬টি, কুড়িগ্রাম জেলায় ১২টি এবং নীলফামারী জেলায় ৪টি। যার জমির পরিমাণ প্রায় ১৭হাজার ১শত ৬০একর। জনসংখ্যা রয়েছে প্রায় ৪১ হাজার ৪শত ৪৯ জন। এর মধ্যে ৯৭৯ জন ভারতীয় নাগরিক হয়ে ভারতে চলে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১৯টি ছিলমহলে কোন জনসংখ্যা ছিলনা। শুধু কৃষি জমি ছিল।

ভারতের ভিতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের কোন বাসিন্দা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে ভারত হতে বাংলাদেশে আসেনি। বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতের কুচবিহার জেলার ভিতর ছিল। ৫১টি ছিটমহলের জনসংখ্যা প্রায় ৭৪ হাজার । জমির পরিমান ৭ হাজার একর। লালমনিরহাট জেলার জেলা প্রশাসক মোঃ আবু জাফর জানান, বিলুপ্ত ছিটমহলের উন্নয়নে সরকার কাজ করছে। এখন বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোর মানুষ দেশের সকল সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহলের সকল সমস্যা একে একে দূরকরা হবে।