তানজীর মহসিন :=
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য এক সত্তার নাম। আমাদের আত্মার আত্মীয়। প্রিয় নেতা। মনের মানুষ। আমৃত্যু যিনি মানুষের কথা ভেবেছেন। ছিলেন দুঃখী মানুষের অকৃত্রিম আশ্রয়।
জীবনের মায়া ছিল না জাতির জনকের। শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে থোরাই কেয়ার করতেন। নিজের জীবনের চেয়েও যে বেশি ভালোবাসতেন বাংলা আর বাংলার মানুষকে। ভাষা আন্দোলন থেকেই তার প্রমাণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির জাতির ধ্রুবতারা। দিশাহীন জাতি তার কল্যাণেই স্বাধীনতার দিশা পেয়েছিল। বায়ান্নর আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত সেই বীজ বপন হয়েছে। আস্তে আস্তে সেই বীজ বড় হয়ে মহীরুহতে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অকুতোভয় নেতৃত্বে তা সম্ভব হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কখনো নিজের জীবনের মায়া করেননি। বারবার মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। একাত্তরের ৭ মার্চ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে শাসকের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। তারা বুঝতে পারলো তাদের বিদায়ের সময় হয়ে এসেছে। কী করে ঠেকানো যায় শেখ মুজিবকে? বন্দি করা হলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করা হলো। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখেও মাথা নত করেননি তিনি। দেশের জন্য হাসিমুখে জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কারা প্রকোষ্ঠের পাশে কবর খোঁড়া হলো। বর্বর শাসকেরা ভেবেছিল জীবনের মায়ায় তিনি পাকিস্তানিদের সব অন্যায় মেনে নেবেন। কিন্তু সেদিন দৃঢ়চিত্তে বলেছিলেন, ‘আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, আমাকে ফাঁসি দাও দুঃখ নাই, শুধু আমার লাশটা বাংলার মাটিতে পৌঁছে দিও।’
কী বীরোচিত উচ্চারণ! শাসকগোষ্ঠী বুঝেছিল, বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিলে ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। তারা পিছু হটেছিল। বাঙালির জাতির জনক বীরদর্পে ফিরে এসেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে।
নয় মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকিস্তানিরা সোনার বাংলাকে শ্মশান বানিয়েছিল। দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বিনির্মাণের কাজে নেমে পড়লেন শেখ মুজিব। মেধা, দক্ষতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমে ঢেলে সাজাতে শুরু করলেন সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতো স্বাধীন এই ভূখণ্ডকে। সোনার বাংলা গড়ার মহান প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান করলেন। তিনি তো তখন বিশ্ব নেতাই বটেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ ধরেই স্বাধীনতা এসেছিল লাল-সবুজের এই দেশে। বিশ্ববাসী তা জানতো।
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের নেতারা বঙ্গবন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ালেন। কেউ বন্ধুর মতো। কেউ প্রতিবেশীর দায়িত্ব নিয়ে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তখন তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রহর গুনছে। শোষণমুক্ত একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন ছিল তাদের। বাংলার আলো-বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। বঙ্গবন্ধু কোটি কোটি মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ শুরু করলেন। মানবজাতির কল্যাণই তার একমাত্র ভাবনা। এই দেশের জন্য, এই দেশের মানুষের জন্য মৃত্যুকে সব সময়ই মুঠোয় নিয়ে ঘুরেছেন।
মানুষকে এত ভালোবেসে কী পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু? জবাবে তিনিই বলেছিলেন ‘জাহান্নামে বসেও আমার চিত্তের অভাব ঘটবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ আমার পিছনে। আমার চেয়ে বড় সুখী আর কে আছে? পাহাড়ের মতো অটল তাদের মনোবল, আমার দেশবাসীর ভালোবাসা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।’
মানুষের ‘ভালোবাসা’ তিনি পেয়েছিলেন। কোটি কোটি মানুষের নয়নের মণি ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি যে ভবিষ্যতে একজন ধৈর্যবান, সহনশীল মহাপুরুষ হবেন, জন্মের শুরুতে সেই আভাসই দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নানা তাঁর মেয়েকে বলেছিলেন, ‘মা সায়রা, তোর ছেলের নাম এমন রাখলাম, যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’ মুজিবুর রহমান নামটি বঙ্গবন্ধুর নানা রেখেছিলেন। তিনি হয়তো সত্যিই ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন।
বঙ্গবন্ধু বড় আবেগী মানুষ ছিলেন। তাঁর হৃদয় ছিল আকাশের মতো বিশাল। মানুষের ভালোবাসার কাঙ্গাল ছিলেন তিনি। বলেছেন, ‘আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’সেই মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা কতটা সীমাহীন’তা তিনি দেখে গেছেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। শুক্রবার। ২৯ শ্রাবণ ১৩৮২। রচিত হলো বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কময় এক অধ্যায়। ভোরের আলো ফোটার আগে কালো পোশাকের ঘাতকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে। এই বাড়িতে পরিবার নিয়ে থাকতেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে তিনি থাকতেন না। কারণ উচ্চাভিলাষী জীবনযাপন তাঁর ভালো লাগতো না। রাষ্ট্রপ্রধান হলেও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও তাঁর বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তিনি নিজেকে সাধারণের একজন বলে মনে করতেন। কখনো ভাবতে পারেননি, যে দেশের জন্য তিনি বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পড়ে থেকেছেন, সেই দেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করবে।
কী ঘটেছিল ওই রাতে? বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে লিখেছেন, ‘মসজিদ থেকে আজাদের ধ্বনি ভেসে আসছে। প্রতিটি মুসলমানকে আহ্বান জানাচ্ছে। সে আহ্বান উপেক্ষা করে ঘাতকের দল এগিয়ে এলো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটাবার জন্য। গর্জে উঠল ওদের হাতের অস্ত্র। ঘাতকের দল হত্যা করল স্বাধীনতার প্রাণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এই নরপিশাচরা হত্যা করল আমার মাতা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে, হত্যা করল মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রনেতা শেখ কামালকে, শেখ জামালকে, তাদের নব পরিণীতা বধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামালকে। যাদের হাতের মেহেদির রং বুকের তাজা রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেল। খুনিরা হত্যা করল বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসেরকে। সামরিক বাহিনীর কর্নেল জামিলকে যিনি রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাদানের জন্য ছুটে আসছিলেন। হত্যা করল কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার ও কর্মকর্তাদের। আর সব শেষে হত্যা করল শেখ রাসেলকে যার বয়স মাত্র দশ বছর। বারবার রাসেল কাঁদছিল ‘মায়ের কাছে যাব বলে।’ তাকে বাবা ও ভাইয়ের লাশের পাশ কাটিয়ে মায়ের লাশের পাশে এনে নির্মমভাবে হত্যা করল। ওদের ভাষায় রাসেলকে Mercy Murder (দয়া করে হত্যা) করেছে।
ওই ঘৃণ্য খুনিরা যে এখানেই হত্যাকাণ্ড শেষ করেছে তা নয়, একই সাথে একই সময়ে হত্যা করেছে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে। হত্যা করেছে কৃষক নেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তার তেরো বছরের কন্যা বেবীকে। রাসেলের খেলার সাথী তাঁর কনিষ্ঠপুত্র ১০ বছরের আরিফকে। জ্যেষ্ঠপুত্র আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সন্তান চার বছরের সুকান্তকে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র সাংবাদিক শহীদ সেরনিয়াবাত ও নান্টুসহ পরিচারিকা ও আশ্রিতাজনকে। আবারও একবার বাংলার মাটিতে রচিত হলো বেঈমানির ইতিহাস।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বেঈমানি করেছিল তাঁরই সেনাপতি মীর জাফর ক্ষমতার লোভে, নবাব হবার আশায়। ১৯৭৫ সালে সেই একই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল বাংলাদেশে।’
ওই কালরাতে ১৭ জনকে হত্যা করেছিল ঘাতকরা। বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তখন স্বামী পরমাণুবিজ্ঞানী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে জার্মানিতে। ছোট বোন শেখ রেহানাও তাঁর সঙ্গে। তা না হলে ওই রাতে তাঁরাও হয়তো ঘাতকের বুলেট থেকে রেহাই পেতেন না। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে তাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন। তাই আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি সারা বিশ্বে তৈরি করেছে অনন্য এক উদাহরণ।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বিশ্ববাসী অকৃত্রিম এক বন্ধুকে হারিয়েছে। শোষিত মানুষ হারিয়েছে তাদের নেতাকে। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা প্রয়াত ফিদেল কাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারাল তাদের একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।’
আপনার সবচেয়ে বড় গুণ কী? বিদেশি সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি খুব ভালোবাসি।’ আপনার বড় দোষ কী, উত্তরে একই কথা বলেছিলেন, ‘এই দেশের মানুষকে আমি বড় বেশি ভালোবাসি।’ কিন্তু আত্মঘাতী বাঙালি এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে জানে না। হায়! যাঁর দুই চোখে ছিল বাংলার মানুষের সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধির প্রত্যাশা সেই মানুষের বুকে গুলি চালাতে একটিবার কাঁপেনি ঘাতকের হাত? একটিবার মনে হয়নি এই স্বাধীনতার গর্ব এনে দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান? বিশ্বের বুকে যিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শেখালেন, তাঁর বুকেই বুলেটের কঠিন আঘাত! এই পাপ কোনোদিন মোচন হবে না। সুত্র: ঢাকা টাইমস ।