বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

এলো অগ্নিঝড়া মার্চ

ঢাকা ব্যুরো :=

প্রতিটি বাঙালীর কাছে মার্চ মাস একটি অগ্নিঝড়া নাম। ১৯৭১ সালের পুরো মার্চ ছিল উত্তালে ভরা। পয়লা মার্চ থেকেই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আর নিয়ন্ত্রণে ছিল না এই বাংলা (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান)।

তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা, বাংলাদেশের শাসনভার কবে কাঁধে নেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তখন ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও থানায় চলছে দখলদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন।অর্থাৎ অলিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চলছে বাংলাদেশ। স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দেশের মানুষের চূড়ান্ত আকাঙ্খা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুহূর্তেই স্বাগত জানালো বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাকে।এই মার্চকে ধরা হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সময়কাল।

পয়লা মার্চ আজকের এইদিনেই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। ফুঁসে ওঠে বাঙালী। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। বীর যোদ্ধারা শুরু করেছিলেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করার সশস্ত্র সংগ্রাম। প্রায় দুই যুগের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরে এ মার্চেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম।ঋতুচক্রের আবর্তনে মার্চ মাস এলে প্রতিটি বাঙালীর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা। যাঁর আগুন ঝরানো ভাষণ শুনলেই দেহের মধ্যে শিহরণ জেগে ওঠে। শরীরের লোমকূপে এক ধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরণ ঘটে।

আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে) লাখ লাখ জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন আসবেন তাঁদের প্রিয় নেতা, কী বলবেন এই হতভাগ্য জাতির জন্য। কী দিক নির্দেশনা অপেক্ষা করছে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি জাতির জন্য।কেননা, বাঙালির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপেক্ষার পালা শেষ। বাঁচার মতো বাঁচা না হলে এ জীবনের মূল্য কী? পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে কোনো মর্যাদাসম্পন্ন জাতি বেঁচে থাকতে পারে না! এ শৃঙ্খল ভাঙতেই হবে!তার আগে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পায়, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়।

ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা করতে শুরু করেন।ইয়াহিয়া  ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোনো কারণ ছাড়াই ৩ মার্চ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সারাদেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে।

দেশের মানুষের আকাঙ্খা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৫ দিনের হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু এতে আন্দোলন প্রশমিত হয় না। অলিখিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই আগুনঝরা ভাষণ দেন।ভাষণের পর  আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো হঠাৎ জ্বলন্ত লাভা যেন নির্গত হতে শুরু করে।বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষের দিকে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বাঙালি জাতি ঘোষণার অপেক্ষাই করছিল। তাঁর এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তুলে। ৭ মার্চের এই দিক নির্দেশনা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করে।শহর থেকে সাধারণ মানুষ পরিবার–পরিজন নিয়ে গ্রামমুখী হতে লাগলো। আওয়ামী লীগের নেতারা মফস্বল ও গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করলেন। আর পশ্চিমা শাসকরা গোলাবারুদ সৈন্যসামন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে এনে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করতে লাগলো।

এদিকে, সারাদেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে প্রহসন শুরু করেন। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনতে থাকে।

১০ মার্চ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইনস তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব-পাকিস্তানে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি যাত্রী পরিবহনের নামে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা আনা হয়। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়তে থাকে।

তবে বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করেন। এমনিভাবে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙালি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মতি জানালে বিদ্রোহ দেখা দেয়। যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ।২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের কুৎসিত, জঘন্য, বর্বরোচিত সিদ্ধান্ত দিয়ে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে সটকে পড়েন।

পরিকল্পনা অনুযায়ীই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা কথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া।ঘড়ির কাটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা ২৬ মার্চ। তারপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

কসাইরা যে এত বড় জঘন্য অত্যাচারে লিপ্ত হবে, এটা ছিল বাঙালির কল্পনার অতীত। সর্বত্রই যেমন উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তাতে জনমনে স্পষ্ট হয়েছিল যে অঘটন কিছু একটা কসাইরা ঘটাতে পারে। তবে তা যে এত নারকীয় হবে, তা ছিল কল্পনার বাইরে।

৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। জাতি পেলো প্রিয় বাংলাদেশ। পৃথিবী পেলো একটি নতুন স্বাধীন দেশ। তবে এ আন্দোলন আকস্মিক নয়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বাঙালির মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আর মার্চে সে ক্ষোভ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই স্বাধীকার আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাই আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতা যেন একই সুতোয় গাঁথা।

আপনার মন্তব্য লিখুন

লেখকের সম্পর্কে

Shahriar Hossain

এলো অগ্নিঝড়া মার্চ

প্রকাশের সময় : ০৭:২৬:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ মার্চ ২০২০
ঢাকা ব্যুরো :=

প্রতিটি বাঙালীর কাছে মার্চ মাস একটি অগ্নিঝড়া নাম। ১৯৭১ সালের পুরো মার্চ ছিল উত্তালে ভরা। পয়লা মার্চ থেকেই পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর আর নিয়ন্ত্রণে ছিল না এই বাংলা (তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান)।

তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা, বাংলাদেশের শাসনভার কবে কাঁধে নেবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তখন ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও থানায় চলছে দখলদার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন।অর্থাৎ অলিখিতভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে চলছে বাংলাদেশ। স্কুল-কলেজসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য দেশের মানুষের চূড়ান্ত আকাঙ্খা অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মুহূর্তেই স্বাগত জানালো বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণাকে।এই মার্চকে ধরা হয় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সময়কাল।

পয়লা মার্চ আজকের এইদিনেই তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। ফুঁসে ওঠে বাঙালী। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। বীর যোদ্ধারা শুরু করেছিলেন পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করার সশস্ত্র সংগ্রাম। প্রায় দুই যুগের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরে এ মার্চেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম।ঋতুচক্রের আবর্তনে মার্চ মাস এলে প্রতিটি বাঙালীর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা। যাঁর আগুন ঝরানো ভাষণ শুনলেই দেহের মধ্যে শিহরণ জেগে ওঠে। শরীরের লোমকূপে এক ধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরণ ঘটে।

আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে) লাখ লাখ জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন আসবেন তাঁদের প্রিয় নেতা, কী বলবেন এই হতভাগ্য জাতির জন্য। কী দিক নির্দেশনা অপেক্ষা করছে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি জাতির জন্য।কেননা, বাঙালির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপেক্ষার পালা শেষ। বাঁচার মতো বাঁচা না হলে এ জীবনের মূল্য কী? পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে কোনো মর্যাদাসম্পন্ন জাতি বেঁচে থাকতে পারে না! এ শৃঙ্খল ভাঙতেই হবে!তার আগে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পায়, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়।

ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা করতে শুরু করেন।ইয়াহিয়া  ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোনো কারণ ছাড়াই ৩ মার্চ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সারাদেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে।

দেশের মানুষের আকাঙ্খা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু সারাদেশে ৫ দিনের হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু এতে আন্দোলন প্রশমিত হয় না। অলিখিতভাবে পূর্ব পাকিস্তান চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই আগুনঝরা ভাষণ দেন।ভাষণের পর  আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো হঠাৎ জ্বলন্ত লাভা যেন নির্গত হতে শুরু করে।বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষের দিকে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বাঙালি জাতি ঘোষণার অপেক্ষাই করছিল। তাঁর এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তুলে। ৭ মার্চের এই দিক নির্দেশনা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করে।শহর থেকে সাধারণ মানুষ পরিবার–পরিজন নিয়ে গ্রামমুখী হতে লাগলো। আওয়ামী লীগের নেতারা মফস্বল ও গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করলেন। আর পশ্চিমা শাসকরা গোলাবারুদ সৈন্যসামন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে এনে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করতে লাগলো।

এদিকে, সারাদেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে প্রহসন শুরু করেন। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনতে থাকে।

১০ মার্চ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইনস তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব-পাকিস্তানে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি যাত্রী পরিবহনের নামে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা আনা হয়। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়তে থাকে।

তবে বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করেন। এমনিভাবে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙালি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মতি জানালে বিদ্রোহ দেখা দেয়। যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ।২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের কুৎসিত, জঘন্য, বর্বরোচিত সিদ্ধান্ত দিয়ে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে সটকে পড়েন।

পরিকল্পনা অনুযায়ীই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা কথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া।ঘড়ির কাটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা ২৬ মার্চ। তারপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।

কসাইরা যে এত বড় জঘন্য অত্যাচারে লিপ্ত হবে, এটা ছিল বাঙালির কল্পনার অতীত। সর্বত্রই যেমন উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তাতে জনমনে স্পষ্ট হয়েছিল যে অঘটন কিছু একটা কসাইরা ঘটাতে পারে। তবে তা যে এত নারকীয় হবে, তা ছিল কল্পনার বাইরে।

৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। জাতি পেলো প্রিয় বাংলাদেশ। পৃথিবী পেলো একটি নতুন স্বাধীন দেশ। তবে এ আন্দোলন আকস্মিক নয়। মুক্তিযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই বাঙালির মনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। আর মার্চে সে ক্ষোভ দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই স্বাধীকার আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠেছিল। তাই আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতা যেন একই সুতোয় গাঁথা।