
নুরুজ্জামান লিটন :=
করোনা-আতঙ্ক শুরু হতে না হতেই চিকেনের উপর কোপ পড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা কিন্তু জানাচ্ছেন এবারের ভাইরাসটির সঙ্গে মুরগির মাংসের কোনও সম্পর্ক নেই। কোন জীব থেকে কোন মারণ ভাইরাস সচরাচর ছড়ায়, সেই তালিকা দেখলেই ঘুচে যাবে যাবতীয় আশঙ্কা। আলোচনা করলেন বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রাণীবিজ্ঞানীরা।
চিকেন কষা, চিকেন রেজালা কিংবা কাবাব। নাম শুনলেই তো জিভে জল। পাতে পড়লে পোয়া বারো। ঝাল ঝাল মুরগির মাংস মানেই আর একটু ভাত বেশি। সেই মুরগির মাংস থেকেই মুখ ফেরাচ্ছেন ক্রেতারা। করোনা গুজবে অনেকেই মুরগির মাংস খেতে ভয় পাচ্ছেন। জেলায় জেলায় বাজারে বিক্রেতাদের মাথায় হাত। কোথাও মুরগির মাংস বিক্রি করতে পেঁয়াজ ফ্রি দিচ্ছেন বিক্রেতারা। কোথাও আবার মুরগির গলায় পোস্টার ঝুলিয়ে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, ‘আমরা করোনা আক্রান্ত নই’। এই পরিস্থিতিতে প্রাণী বিশেষজ্ঞরা সাফ জানাচ্ছেন, অযথা ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। গুজবে একদম কান নয়।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা ধরনের ভুল তথ্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। মুরগির মাংস কিংবা ডিম খেলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই। মুরগির মাংস থেকে ‘মরফিন’ ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলেও প্রচার হয়েছে। আসল কথা হল, ওই নামে কোনও ভাইরাস-ই নেই, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য, মুরগির মাংস কিংবা ডিম প্রোটিনের একটি অন্যতম উৎস। গুজবে কান দিয়ে যাঁরা এসব খাচ্ছেন না, তাঁদের শরীরে প্রাণিজ প্রোটিনের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। ফলে কমতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা।
তাছাড়া মুরগির মাংসে ট্রিপটোফান নামে একটি উপাদান থাকে, যা হ্যাপি হরমোন নিঃসরণে সহায়তা করে। মানব শরীরে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রাজ্য প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সিদ্ধার্থ জোয়ারদার জানিয়েছেন, করোনা আসলে একটা ভাইরাসের পরিবার। এর মধ্যে অনেক ভাইরাস আছে। সবার আচরণ সমান নয়। ফলে করোনা নাম নিয়ে লাফালাফি করার কিছু নেই। এই প্রাণীবিজ্ঞানীর বক্তব্য যে, মানুষের শরীরে যেমন করোনা থাবা বসাতে পারে, তেমনই পশু-পাখিও আক্রান্ত হতে পারে করোনা ভাইরাসে। কিন্তু সংক্রমণের ধরন আলাদা। করোনা ভাইরাসের কারণে পোলট্রির ক্ষেত্রে ইনফেকসিয়াস ব্রঙ্কাইটিস হয়। এর জন্য ভ্যাকসিন আছে।
টার্কির ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের কারণে ব্লু কম্ব অসুখ হয়। এতে টার্কির মাথার লাল ঝুঁটি নীল হয়ে যায়। কালশিরে পড়ে যায়। কিন্তু মুরগি বা টার্কির করোনা ভাইরাস কোনওভাবেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। সেটা সম্ভব নয়।
রাজ্য প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের আর এক অধ্যাপক ড. ইন্দ্রনীল সামন্ত বলেছেন, যে কোনও ভাইরাস শরীরে ঢুকলে তাকে গ্রহণ করার জন্য একটা উপযুক্ত রিসেপটর বা গ্রাহক লাগে। মুরগি থেকে আমাদের শরীরে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করতে পারবে না, তার কারণ হল, রিসেপটর অর্থাৎ গ্রাহক কোষ মিলবে না। সুতরাং ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। নিশ্চিন্তে মুরগির মাংস খাওয়া যেতেই পারে। তবে, করোনা আতঙ্কে নয়, যেকোনও জিনিসই স্বাস্থ্য সম্মতভাবে রান্না করে খাওয়া উচিত।
অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের কথায়, নোভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নামে যে ভাইরাসের কথা বলা হচ্ছে, সেটি নতুন জেনেটিক ভাইরাস। এটি পুরোপুরি হিউম্যান ভাইরাস। মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। তাঁর বক্তব্য, মলিকুলার গঠনের জন্য প্রত্যেক ভাইরাসেরই একটা প্রজাতিগত বাধা আছে। কোভিড-১৯ ভাইরাস জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে এক নতুন চেহারা নিয়েছে। এই ভাইরাসটিতে তিন-চারটি প্রোটিন রয়েছে। তার মধ্যে স্পাইক প্রোটিন একটি। মানব শরীরে গ্রাহক কোষের সঙ্গে এই প্রোটিনের গঠনের মিল রয়েছে। ফলে সংক্রমণের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। কিন্তু যে করোনা ভাইরাসে মুরগি আক্রান্ত হয়, সেটি কোনওভাবে আমাদের শরীরে ছড়াতে পারবে না। প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, অনেক বন্যজন্তুর মধ্যেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে বাদুড়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত।
কীভাবে মানুষের শরীরে নোভেল করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ল, সে সম্পর্কে ভাইরাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চালানো প্রাণীবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এটা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে কোনও বন্যজন্তু থেকে হয়তো আকস্মিকভাবে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে ঢুকে পড়েছে। তার পর জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে এক নতুন চেহারা নিয়েছে।
রাজ্য প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত উপাচার্য ড. পূর্ণেন্দু বিশ্বাস জানিয়েছেন, মুরগির মাংস সুস্বাদু ও ভালো প্রোটিন সমৃদ্ধ সস্তার খাবার। ফলে গুজবে কান দিয়ে মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়া থেকে বঞ্চিত হলে আখেরে আমাদেরই ক্ষতি হয়ে যাবে। কারণ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও শারীরিক বিকাশের জন্য প্রোটিন খুবই জরুরি।