দেশে পর্যাপ্ত চালের মজুদ রয়েছে এবং ভবিষ্যতে যে সংকটই আসুক না কেন, আওয়ামী লীগ সরকার তা শক্তভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে বলেও এ সময় দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘কভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে যে সাময়িক প্রয়োজন উদ্ভূত হয়েছে তা মেটানো এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে যে ক্ষয়ক্ষতি সৃষ্টি হবে তা পুনরুদ্ধারের কৌশল বিবেচনায় নিয়ে অর্থমন্ত্রী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এটি আওয়ামী লীগ সরকারের ১৭তম এবং বর্তমান মেয়াদের দ্বিতীয় বাজেট। আর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে সরকার পরিচালনা করেছিলেন সেখানে তিনটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। সে হিসাবে এটি আওয়ামী লীগের ২০তম বাজেট। যেটি আওয়ামী লীগ সরকার এদেশকে উপহার দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বাজেটে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় জীবন ও জীবিকা রক্ষার ওপর প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, কৃষি, কর্মসৃজন ও সামাজিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) অনুমোদন করেছে। যার মাধ্যমে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে উত্তরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া আমরা আগামী অর্থবছর হতে পাঁচ বছর মেয়াদি ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করব যার মূল প্রতিপাদ্য হবে দারিদ্র্য ও আয় বৈষম্য কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা। শেখ হাসিনা বলেন, ‘হয়তো তখন আমরা বেঁচে থাকব না, কিন্তু কাজ আমরা করে যাচ্ছি, কর্মপন্থা দিয়ে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে যারা আসবে তারা যেন এটা অনুসরণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’
প্রধানমন্ত্রী আশংকা ব্যক্ত করেন, বাংলাদেশ বিগত ১২ বছরে গড়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচনে সক্ষম হলেও কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাবে চলতি অর্থবছরে এ ধারায় কিছুটা হয়তো ছন্দপতন হতে পারে। তিনি বলেন, এ মহামারীর কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে যাওয়ার প্রভাবে আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা অনেকে করেছেন। তিনি বলেন, কিন্তু অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আমরা যে সুবিশাল আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করে বাস্তবায়ন শুরু করেছি, তার মাধ্যমে আমরা এ সম্ভাবনাকে অনেকটাই রোধ করতে সক্ষম হব বলে আমি বিশ্বাস করি।
বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং সরকারদলীয় জ্যেষ্ঠ সাংসদ বেগম মতিয়া চৌধুরীও আলোচনায় অংশ নেন। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় স্পিকারের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কভিড-১৯ মোকাবিলা এবং এর অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা গতানুগতিক বাজেট হতে সরে এসে সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে এসেছি। স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ, প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কভিড-১৯ মোকাবিলায় চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করে জনজীবনকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ন্যাশনাল প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন আরম্ভ করা হয়েছে। কভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বর্তমানে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’ ‘তাছাড়া কভিড-১৯ মোকাবিলায় জরুরি চাহিদা মেটানোর জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বাজেট বরাদ্দের দিক দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অবস্থান পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল অষ্টম স্থানে’, যোগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অত্যন্ত অল্প সময়ে ২ হাজার ডাক্তার ও ৬ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। আরও ২ হাজার ডাক্তার ও ৪ হাজার নার্সের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাদের শিগগিরই নিয়োগ দেওয়া হবে। হেলথ টেকনোলজিস্ট, কার্ডিওগ্রাফার এবং ল্যাব অ্যাটেনডেন্টের ৩ হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসপরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এ পর্যন্ত তার সরকার ঘোষিত প্রায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের পুনরুল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের চলমান দুর্নীতিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রাখারও দৃঢ় প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করেন। এ সময় তিনি বিরোধীদলীয় উপনেতার বক্তৃতার সঙ্গে একমত পোষণ করে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এক মাসের খাবারের বিল ২০ কোটি টাকা কী করে হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এখানে বিরোধী দলের উপনেতা ঠিকই বলেছেন, থাকা-খাওয়া বাবদ মেডিকেল কলেজের হিসাব অনুযায়ী ২০ কোটি টাকা ব্যয় একটু বেশিই মনে হচ্ছে। তবে, এটা আমরা তদন্ত করে দেখছি, এত অস্বাভাবিক কেন হবে। এখানে কোনো অনিয়ম হলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’ শেখ হাসিনা দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে, এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দুর্নীতি সমূলে উৎপাটন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ।’
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির সর্বশেষ পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, তার সরকারের যথাযথ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বিশে^র অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার নিম্নপর্যায়ে রয়েছে। যদিও একটি মৃত্যুও তার সরকারের কাম্য নয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি কীভাবে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া যায় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বারবার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছি। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা এবং অপরকে সুরক্ষিত রাখাটা সকলের দায়িত্ব। তাই আশা করি সকলে নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন।’ প্রধানমন্ত্রী করোনাপরবর্তী সময়ে বিশে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহলের আশংকার সঙ্গে একমত পোষণ করে সারা দেশে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাপক বৃক্ষরোপণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
‘নিম্ন আয় ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে’Ñ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ভাতা এবং অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগীর সংখ্যা ১১ লাখ ৫ হাজার জন বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
তার সরকার বরাবরই শিক্ষা খাতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা খাতে ৯৫ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা জিডিপির ৩.১ শতাংশ এবং মোট বাজেট বরাদ্দের ১৭ শতাংশ।’ তিনি বলেন, ‘করোনার এই মহামারীর মধ্যেও আমরা বিশেষ ব্যবস্থায় ১ কোটি ৩৭ লাখ প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা প্রদান করেছি। এছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নতুন পোশাক, জুতা ও ব্যাগ ক্রয়ের জন্য ১ হাজার টাকা করে আগামী ডিসেম্বর মাসে প্রদান করা হবে।’ ‘নন-এমপিওভুক্ত যারা তাদের জন্যও আমরা ৪৬ কোটি টাকার ওপরে বরাদ্দ দিয়েছি’Ñ বলেন তিনি।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় মোট উপকারভোগীর সংখ্যা হলো ১২ কোটি ৩৩ লাখ ৫৫ হাজার জন উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আগামী অর্থবছরে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যা মোট বাজেট বরাদ্দের ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ এবং জিডিপির ৩ দশমিক ০১ শতাংশ।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত ২ মে, ২০২০ দ্য ইকোনমিস্ট একটি গবেষণা প্রতিবেদনে চারটি মানদ-ের ভিত্তিতে সবল অর্থনীতির ৬৬টি দেশের তালিকা করেছে, সেখানে বাংলাদেশ শক্তিশালী নবম অবস্থানে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘চলতি জুন মাসেই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৩৫ বিলিয়ন এবং প্রবাসী আয় ১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। এছাড়া ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস কর্র্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত টুয়েন্টি টুয়েন্টি গ্লোবাল পিস ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৪ থেকে ৭ ধাপ এগিয়ে ৯৭তে উন্নীত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কাজেই আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে আমরা সফলভাবে এ মহামারীর অর্থনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের অভিযাত্রায় পুনরায় শামিল হব। কারণ, বিশ্ব মানদ-ে আমাদের রয়েছে শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক অবস্থান।’ আগামী বাজেটকে জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী ও সুষম আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী এই বাজেটের সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্য বাস্তবায়নে আরও এগিয়ে যাবে বলেও প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করেন।