রোকনুজ্জামান রিপন:/=
বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান শাসকদের কারাগার থাকাকালে জেল অভিজ্ঞতা নিয়ে ডায়রিতে বিস্তর লিখেছেন।
ওইসব লেখায় পাকিস্তান সেনা শাসকরা বাংলাদেশের জাতিরজনকের সঙ্গে যে অমানবিক আচরণ করেছে তা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর লেখায়।ওই লেখার খাতার কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে চোখের জল মুছলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু কারাগারে কী ধরনের যন্ত্রণায় থাকতেন, তা বাইরে বলতেন না।
যা জানতে পেরেছেন, লেখা থেকেই জেনেছেন।আজ বুধবার ঢাকায় জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা এ স্মৃতিচারণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাঁদের বাসা শুধু আক্রমণই করেই ক্ষান্ত থাকেনি দখলদার পাকিস্তানি সেনারা। দীর্ঘ নয় মাস বাড়ি লুটপাট করেছে।বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর সবকিছু লুট হয়ে যায়। কিন্তু কারাগারের বঙ্গবন্ধুর নরক যন্ত্রনার বিবরণ তাঁর লেখার খাতাগুলো কেউ নেয়নি। মনে হয় তাদের পছন্দ হয়নি। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যার দিনেও বাড়িও লুট হয়।
শেখ হাসিনা বোন রেহানাসহ বিদেশে থাকায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যান।এরপর তিনি দেশে ফিরে খাতাগুলো উদ্ধার করেছেন।এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওই সময়কার দিনলিপির তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বুধবার সংসদে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নুর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ’কারাগারের রোজনামচা’ মূলত ১৯৬৬ সাল থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত।একাত্তর সাল থেকে আমরা তাঁর কোনো লেখা পাইনি। কারণ একাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু কারাগারে (পাকিস্তানে) কিভাবে ছিলেন, কী অবস্থায় ছিলেন, আসলে তার কিছু আমরা জানিনা।
সামান্য একটা লাইন পাওয়া গেছে, আইয়ুব খানের ডায়েরি, অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত। সেখানে তাঁর সম্পর্কে কিছু কমেন্ট করা আছে। বঙ্গবন্ধুকে যখন কোর্টে নিয়ে আসা হত, তিনি আসতেন, দাঁড়াতেন, বসতে বললে বসতেন।এসে দাঁড়িয়েই জয় বাংলাদেশ বলতেন। বলতেন, আমাকে যা খুশি তাই করো, আমার যেটা করার আমি তা করে ফেলেছি। অর্থাৎ আমার বাংলাদেশ তো স্বাধীন হবেই।
এর বাইরে একাত্তরের কিছু আমি পাইনি।শেখ হাসিনা বলেন, “তবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখনও আমার চেষ্টা আছে ওখান (পাকিস্তান) থেকে কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় কী না?১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনারা আটক করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়।
ওই রাতেই বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর শুরু হয় বর্বর হামলা। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। তার ডাকে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের লড়াইয়ে।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর বয়স হত ১০০ বছর।মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বিশ্ব জনমতের চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।
১০ জানুয়ারি মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু লন্ডন এবং দিল্লি হয়ে পৌঁছান ঢাকায়। দেশের জেলখানার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি জেলখানায় ছবি আনতে গিয়েছিলাম। জেলখানা ভেঙ্গে নতুনভাবে করা হয়েছে।
ছোট্ট একখানা দেয়ালের ছবি পেয়েছি, আর কিছু পাইনি। তবে আমার চেষ্টা আমি করে যাচ্ছি। বাবার লেখা খাতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে চোখ মোছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।তিনি বলেন, ‘বাবা যখন ঢাকার সেনানিবাস কুর্মিটোলা কারাগারে ছিলেন, তখন মা সব সময় একটা খাতা দিয়ে আসতেন লিখে রাখার জন্য। আমি গেলে আমাকে বাবা লেখা খাতাটা দিয়ে দিতেন।
বলতেন, এখন খাতাটা পড়বি না। যখন আমি থাকব না, তখন পড়িস। এরপর আর খাতাগুলো ধরিনি।’ বঙ্গবন্ধুর কারাজীবন সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কারাজীবনের কষ্ট–যন্ত্রণা কিচ্ছু বলেননি বাবা। যতটুকু জেনেছি এই লেখা পড়ে।
তিনি নিজে থেকে বলতে চাইতেন না। ছোট বোন শেখ রেহানাকে জিজ্ঞেস করেছি, তুই কিছু শুনেছিস। ও ছোট ছিল, মাঝেমধ্যে বাবার কাছে জানতে চাইত। সেদিনও ওকে জিজ্ঞেস করেছি। ও বলল, বাবা বলতেন, তোরা এগুলো জানলে সহ্য করতে পারবি না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৫–৭৭ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডিক্লাসিফাউট ডকুমেন্ট পুরোটাই সংগ্রহ করা হয়েছে। এ থেকে হয়তো কিছু জানা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘এগুলো হার্ডডিস্কে ছিল। এখন সেগুলো প্রিন্ট নেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের সময় ধীরে ধীরে দেখছি।’
এর আগে জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক সম্পূরক প্রশ্নে বলেন, পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু কেমন ছিলেন, এ বিষয়ে বই হতে পারে। বঙ্গবন্ধু সারা জীবন সংসদীয় রাজনীতি বিশ্বাস করতেন। পাকিস্তান আমলে সংসদের বিতর্কগুলো নিয়েও বই প্রকাশ করা যায়। জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বঙ্গবন্ধুর ওপর বিশেষ অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, সংসদের ৩৫০ জন সাংসদ অন্তত সাত দিন আলোচনা করতে পারেন।