রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সৌদি থেকে ফিরে খেজুর বাগান, বছরে বিক্রি কোটি টাকা

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।।  অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন আব্দুল মোতালেব। ১০ হাজার টাকা বেতনে খেজুর বাগানে চাকরি নিয়েছিলেন। চাষাবাদ রপ্ত করে তিন বছরের মাথায় দেশে ফেরেন। সঙ্গে আনেন খেজুরের বীজ। বাগান করে কয়েক বছরের মধ্যে বদলে ফেলেন ভাগ্য। এখন বছরে কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেন তিনি।
আব্দুল মোতালেব (৫৩) ময়মনসিংহের ভালুকার পাড়াগাঁও গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। তিনি সফল উদ্যোক্তা। সবাই তাকে ‘খেজুর মোতালেব’ বলে ডাকেন।
স্থানীয়রা জানায়, আব্দুল মোতালেব সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। আল কাসিম জেলার আল মাছনাব গ্রামের খালেদ আশরাফের খেজুরের বাগানে চাকরি নেন। মাসে বেতন পান ১০ হাজার টাকা। বাগানে কাজ করার সুবাদে খেজুর চাষের কলাকৌশল খুব দ্রুত রপ্ত করে নেন। মালিকের কাছ থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে ২০০১ সালে দেশে আসেন। আসার সময় আনেন ৩৫ কেজি খেজুরের বীজ। চারা উৎপাদন করে বসতভিটার পাশের ৭০ শতক জমিতে রোপণ করে পরিচর্যা শুরু করেন। খেজুর চাষ করা নিয়ে স্থানীয়রা নানা কথা বলতে থাকেন, এমনকি অনেকে পাগল আখ্যা দিয়েছিলেন। তখন থেকে তাকে খেজুর মোতালেব বলে ডাকা শুরু হয়।
প্রতিবেশীরা নানা ধরনের কথা বললেও স্ত্রী মজিদা বেগম সাহস জোগান এবং বাগানের কাজে সহযোগিতা করেন। ছয় বছরের মাথায় গাছে আসে কাঙ্ক্ষিত ফল। পূরণ হয় স্বপ্ন। প্রথম দিকে গাছের খেজুর মানুষকে খাইয়ে বীজ রেখে তা থেকে আবার চারা উৎপাদন করতেন। ধীরে ধীরে বাগানে ফল ধরা গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এভাবে মোতালেবের খেজুর বাগান সারাদেশে পরিচিতি পায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অসাধ্য সাধন করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন দেশের মাটি সৌদির খেজুর চাষের উপযোগী। সফলতা আসার পর ফল ধরা গাছে কলম দিয়ে চারা উৎপাদনেও সফলতা পান। প্রথম দিকে কলম দেওয়া একেকটি চারা দুই লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। ২০০৮ সালে বাগানের খেজুর ও চারা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে তার বাগানে ফল দেওয়া ২০০টি খেজুর গাছ এবং বিক্রি উপযোগী ৫০০টি চারা কলম রয়েছে।
২৩ বছরের ব্যবধানে চারা ও খেজুর বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেছেন মোতালেব। বর্তমানে করোনার সংক্রমণের কারণে বিক্রি কিছুটা কম। এ বছর খেজুর বিক্রি করেছেন পাঁচ লাখ টাকার। ৭০টি চারা কলম ৫০ হাজার করে ৩৫ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। খরচ বাদে চলতি বছরে তার আয় হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। অবশ্য গত বছর দুই কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেছেন তিনি। তার বাগানে ১০-১২ জন কর্মী রয়েছেন।
জানা যায়, একসময় মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া মাটির ঘরে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন। বাগানের আয়ে ইতোমধ্যে ২০০ শতক জমি কিনেছেন, দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার, চার শতক জমিতে দোতলা বাড়ি করেছেন মোতালেব।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের ভালুকার সিডস্টোর বাজার থেকে টাঙ্গাইলের সখিপুর সড়কের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই মোতালেবের খেজুর বাগানের দেখা মিলবে। সেখানে চাষ হয় আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, মরিয়ম ও বকরি জাতের খেজুর। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা গাছেও ধরছে খেজুর।
বাগানে সারিবদ্ধভাবে শত শত গাছ লাগানো। সেচ দেওয়ার জন্য রয়েছে বড় ফুট প্লাস্টিকের পাইপ। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো তার কলম দিয়ে চারা উৎপাদন কৌশল দেখার মতো। এমন কৌশল অবলম্বন করেছেন যেখানে দেখা যাবে বাগানের ফলবান গাছ ফেটে কলম দেওয়া চারা বের হচ্ছে। একেকটি গাছ থেকে অনেক চারা উৎপাদন করছেন তিনি।
আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘বর্তমানে বাগানে ৭০০টি ফল ধরা গাছ ও ১০০টি পুরুষ গাছ রয়েছে। এরমধ্যে ফল দেওয়ার উপযোগী গাছের সংখ্যা ২০০টি এবং বিক্রির উপযোগী কলম দেওয়া চারা রয়েছে ৫০০টি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী বছর ফলবান গাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করতে পারবো। পাশাপাশি ১০০টি কলম দেওয়া চারা বিক্রি করে ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হবে।’
বাগানে ফল দেওয়া ২০০টি খেজুর গাছ এবং বিক্রি উপযোগী ৫০০টি চারা কলম রয়েছে
তিনি বলেন, ‘যাদের উঁচু পতিত জমি আছে তারা ইচ্ছা করলেই সৌদি খেজুরের চাষ করে সহজেই লাভবান হতে পারেন। বেকার তরুণরা খেজুর বাগান করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারেন। খেজুর চাষের ওপর কৃষি বিভাগের উদ্যোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। ভবিষ্যতে ২০০ শতক কেনা জমিতে দুই ছেলের জন্য আরও দুটি খেজুর বাগান করার পরিকল্পনা আছে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মতিউজ্জামান বলেন, মোতালেবের সফলতা দেখে অনেকে খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তার কাছ থেকে চারা নিয়ে অনেকে এখন সৌদি খেজুর চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ চালু করতে কৃষি অধিদফতরে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।

সৌদি থেকে ফিরে খেজুর বাগান, বছরে বিক্রি কোটি টাকা

প্রকাশের সময় : ০৩:৫২:১০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি।।  অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে সৌদি আরব গিয়েছিলেন আব্দুল মোতালেব। ১০ হাজার টাকা বেতনে খেজুর বাগানে চাকরি নিয়েছিলেন। চাষাবাদ রপ্ত করে তিন বছরের মাথায় দেশে ফেরেন। সঙ্গে আনেন খেজুরের বীজ। বাগান করে কয়েক বছরের মধ্যে বদলে ফেলেন ভাগ্য। এখন বছরে কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেন তিনি।
আব্দুল মোতালেব (৫৩) ময়মনসিংহের ভালুকার পাড়াগাঁও গ্রামের মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে। তিনি সফল উদ্যোক্তা। সবাই তাকে ‘খেজুর মোতালেব’ বলে ডাকেন।
স্থানীয়রা জানায়, আব্দুল মোতালেব সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে ১৯৯৮ সালে সৌদি আরবে পাড়ি জমান। আল কাসিম জেলার আল মাছনাব গ্রামের খালেদ আশরাফের খেজুরের বাগানে চাকরি নেন। মাসে বেতন পান ১০ হাজার টাকা। বাগানে কাজ করার সুবাদে খেজুর চাষের কলাকৌশল খুব দ্রুত রপ্ত করে নেন। মালিকের কাছ থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে ২০০১ সালে দেশে আসেন। আসার সময় আনেন ৩৫ কেজি খেজুরের বীজ। চারা উৎপাদন করে বসতভিটার পাশের ৭০ শতক জমিতে রোপণ করে পরিচর্যা শুরু করেন। খেজুর চাষ করা নিয়ে স্থানীয়রা নানা কথা বলতে থাকেন, এমনকি অনেকে পাগল আখ্যা দিয়েছিলেন। তখন থেকে তাকে খেজুর মোতালেব বলে ডাকা শুরু হয়।
প্রতিবেশীরা নানা ধরনের কথা বললেও স্ত্রী মজিদা বেগম সাহস জোগান এবং বাগানের কাজে সহযোগিতা করেন। ছয় বছরের মাথায় গাছে আসে কাঙ্ক্ষিত ফল। পূরণ হয় স্বপ্ন। প্রথম দিকে গাছের খেজুর মানুষকে খাইয়ে বীজ রেখে তা থেকে আবার চারা উৎপাদন করতেন। ধীরে ধীরে বাগানে ফল ধরা গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এভাবে মোতালেবের খেজুর বাগান সারাদেশে পরিচিতি পায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অসাধ্য সাধন করে সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন দেশের মাটি সৌদির খেজুর চাষের উপযোগী। সফলতা আসার পর ফল ধরা গাছে কলম দিয়ে চারা উৎপাদনেও সফলতা পান। প্রথম দিকে কলম দেওয়া একেকটি চারা দুই লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। ২০০৮ সালে বাগানের খেজুর ও চারা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি শুরু করেন। বর্তমানে তার বাগানে ফল দেওয়া ২০০টি খেজুর গাছ এবং বিক্রি উপযোগী ৫০০টি চারা কলম রয়েছে।
২৩ বছরের ব্যবধানে চারা ও খেজুর বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেছেন মোতালেব। বর্তমানে করোনার সংক্রমণের কারণে বিক্রি কিছুটা কম। এ বছর খেজুর বিক্রি করেছেন পাঁচ লাখ টাকার। ৭০টি চারা কলম ৫০ হাজার করে ৩৫ লাখ টাকা বিক্রি করেছেন। খরচ বাদে চলতি বছরে তার আয় হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। অবশ্য গত বছর দুই কোটি টাকার চারা ও খেজুর বিক্রি করেছেন তিনি। তার বাগানে ১০-১২ জন কর্মী রয়েছেন।
জানা যায়, একসময় মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া মাটির ঘরে স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করতেন। বাগানের আয়ে ইতোমধ্যে ২০০ শতক জমি কিনেছেন, দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার, চার শতক জমিতে দোতলা বাড়ি করেছেন মোতালেব।
ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের ভালুকার সিডস্টোর বাজার থেকে টাঙ্গাইলের সখিপুর সড়কের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই মোতালেবের খেজুর বাগানের দেখা মিলবে। সেখানে চাষ হয় আজোয়া, শুক্কারি, আম্বার, মরিয়ম ও বকরি জাতের খেজুর। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা গাছেও ধরছে খেজুর।
বাগানে সারিবদ্ধভাবে শত শত গাছ লাগানো। সেচ দেওয়ার জন্য রয়েছে বড় ফুট প্লাস্টিকের পাইপ। সবচেয়ে আশ্চর্য হলো তার কলম দিয়ে চারা উৎপাদন কৌশল দেখার মতো। এমন কৌশল অবলম্বন করেছেন যেখানে দেখা যাবে বাগানের ফলবান গাছ ফেটে কলম দেওয়া চারা বের হচ্ছে। একেকটি গাছ থেকে অনেক চারা উৎপাদন করছেন তিনি।
আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘বর্তমানে বাগানে ৭০০টি ফল ধরা গাছ ও ১০০টি পুরুষ গাছ রয়েছে। এরমধ্যে ফল দেওয়ার উপযোগী গাছের সংখ্যা ২০০টি এবং বিক্রির উপযোগী কলম দেওয়া চারা রয়েছে ৫০০টি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আগামী বছর ফলবান গাছ থেকে ২০-২৫ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করতে পারবো। পাশাপাশি ১০০টি কলম দেওয়া চারা বিক্রি করে ৫০ লাখ টাকার মতো আয় হবে।’
বাগানে ফল দেওয়া ২০০টি খেজুর গাছ এবং বিক্রি উপযোগী ৫০০টি চারা কলম রয়েছে
তিনি বলেন, ‘যাদের উঁচু পতিত জমি আছে তারা ইচ্ছা করলেই সৌদি খেজুরের চাষ করে সহজেই লাভবান হতে পারেন। বেকার তরুণরা খেজুর বাগান করে বেকারত্ব ঘোচাতে পারেন। খেজুর চাষের ওপর কৃষি বিভাগের উদ্যোগে সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। ভবিষ্যতে ২০০ শতক কেনা জমিতে দুই ছেলের জন্য আরও দুটি খেজুর বাগান করার পরিকল্পনা আছে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের খামারবাড়ির উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মতিউজ্জামান বলেন, মোতালেবের সফলতা দেখে অনেকে খেজুর চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। তার কাছ থেকে চারা নিয়ে অনেকে এখন সৌদি খেজুর চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ চালু করতে কৃষি অধিদফতরে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।