ডেস্ক রিপোর্ট ।।
ভারতনির্ভরতা কমাবে পেঁয়াজের নতুন দুই জাত। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়। ফলে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যার বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে। নতুন জাত দিয়ে গ্রীষ্মকালীন উৎপাদন শুরু হলে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে এই ব্যবধান কমে আসবে।
দেশে পেঁয়াজের যে উৎপাদন, তার সঙ্গে চাহিদার ব্যবধান ১০ শতাংশ। তবে শীতে উৎপাদনের পর সারা বছর সংরক্ষণজনিত জটিলতায় তা ২৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। আশার কথা হচ্ছে, দেশে এমন দুটি জাতের পেঁয়াজের উদ্ভাবন হয়েছে, যা একটি মৌসুমনির্ভরতা আর থাকবে না।
যে সময় দেশে মজুত কমে যাওয়ার পর ভারতের মজুত পরিস্থিতির কারণে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে, সে সময়ই উৎপাদনে চলে আসবে নতুন এই জাত। জাত দুটি উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, যা সংক্ষেপে বিনা নামে পরিচিত। জাত দুটি কৃষকদের মধ্যে পৌঁছাতে জোরেশোরে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, কৃষকরা সঠিক পরামর্শ মেনে চাষাবাদ করলে বাংলাদেশে পেঁয়াজের বিপ্লব ঘটবে।
নতুন দুই জাত বিনাপেঁয়াজ-১ ও বিনাপেঁয়াজ-২ এ বছর থেকেই চাষের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
নতুন উদ্ভাবিত গ্রীষ্মকালীন এই দুই জাতের পেঁয়াজ হেক্টরপ্রতি ৮ থেকে ১০ টন উৎপাদন হবে। অন্য জাতের পেঁয়াজ শীতকালে ও এটি গ্রীষ্মকালে উৎপাদন হওয়ায় বাংলাদেশের উৎপাদিত সব পেঁয়াজ মিলিয়ে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা মিটবে বলে জানাচ্ছেন বিনার বিজ্ঞানীরা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের একটি অংশ সংরক্ষণকালে নষ্ট হয়। ফলে ৮ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়, যার বেশির ভাগই আসে ভারত থেকে।
গত দুই বছর ভারতে বন্যা ও উৎপাদন সমস্যার কারণে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশে পণ্যটির দাম ব্যাপক হারে বেড়ে গিয়েছিল। অন্য দেশ থেকে আমদানি করেও পরিস্থিতি সামলানো যায়নি।
মিসরসহ নানা দেশ থেকে আমদানি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরাও পড়েন ক্ষতির মুখে। দাম ছিল উচ্চ, পণ্য দেশে আসতে আসতে নতুন পেঁয়াজ চলে আসে, ফলে দাম কমে যায়। এবারও ভারত রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে, এমন গুঞ্জনে গত দুই সপ্তাহেই পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আগামী এক মাসেও পরিস্থিতি পাল্টাবে না।
এ অবস্থায় গ্রীষ্মকালীন জাত চাষ হলে আমদানি আর করতে হবে না।
এবার চারা উৎপাদনে গুরুত্ব
বিনার বিজ্ঞানীরা বলছেন, উদ্ভাবিত জাতের পেঁয়াজ বিপুল পরিমাণে জমিতে চাষের জন্য প্রথমে বীজ উৎপাদনকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
এ জন্য রবি মৌসুমে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহকে নির্ধারণ করে জমিতে বীজ বপন করতে হবে।
খরিপ-১ মৌসুমে (গ্রীষ্মকালীন ফসল) কন্দ (পেঁয়াজের চারা) উৎপাদনের জন্য মধ্য জানুয়ারিতে বীজ বপন করতে হবে।
এ ছাড়া রবি মৌসুমে বীজের জন্য চারা রোপণ করলে অবশ্যই ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে মধ্য ডিসেম্বরেই (অগ্রহায়ণের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চতুর্থ সপ্তাহ) করতে হবে। চারা থেকে চারার দূরত্ব হবে ১৫ সেমি এবং সারি থেকে সারি ২০ সেমি দূরে থাকতে হবে।
খরিফ-১ মৌসুমে কন্দ উৎপাদনের জন্য চারা রোপণ করতে হবে মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহ (ফাল্গুনের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহ) পর্যন্ত। চারা থেকে চারার দূরত্ব ১০ সেমি ও সারি থেকে সারি ১০ সেমি দূরে থাকবে।
উদ্ভাবকরা যা বলছেন
বিনাপেঁয়াজ-১ ও বিনাপেঁয়াজ-২ জাতের উদ্ভাবক বিনার প্রশাসন ও সাপোর্ট সার্ভিসের পরিচালক আবুল কালাম আজাদ। সহযোগী গবেষক হিসেবে ছিলেন ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কামরুজ্জামান ও ফাহমিনা ইয়াসমিন।
ফাহমিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘ভালো ফলন পেতে হলে সতেজ ও পুষ্ট বীজ বাছাই করতে হবে। এ ছাড়া ভিটাভেক্স-টু হান্ড্রেড ছত্রাকনাশক দিয়ে কেজিপ্রতি ২.৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
প্রতি হেক্টরে ৬ থেকে ৭ কেজি বীজ বপন করলে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাবে।
ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কামরুজ্জামান বলেন, এ জাতের পেঁয়াজের গাছ পরিপক্ব হলে পাতা ক্রমশ হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং গলার দিকের টিস্যু নরম হয়ে যায়। শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ গাছে পরিপক্বতা এলে ফলন উত্তোলন করে পাতা ও শিকড় কেটে ছায়াময় ও শীতল স্থানে ৫ থেকে ৭ দিন রেখে কিউরিং করতে হবে৷ এরপর ভালো পেঁয়াজগুলোকে বাছাই করে ঘরের মেঝে বা একটু উচ্চতায় বাঁশ বা প্লাস্টিকের মাচায় রেখে সংরক্ষণ করতে হবে।
নতুন দুই জাতের উদ্ভাবক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘বীজ পরিপক্ব হওয়ার সময় কদমের মুখ ফেটে যায় এবং কালো বীজ দেখা যায়। শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ গাছে পরিপক্বতা আসলে ফসল উত্তোলন শুরু করতে হবে। একই সময়ে সব পুষ্পদণ্ডের বীজ পরিপক্ব হয় না। এ জন্য ২ থেকে ৩ বার বীজ তুলতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পুষ্পদণ্ডের নিচ থেকে কদমের ৫ থেকে ৭ সেমি অংশসহ পরিপক্ব কদমগুলো তুলতে হবে৷ তোলার পর কয়েক দিন রোদে শুকিয়ে প্রথমে বীজ থেকে খোসা আলাদা করতে হবে। এরপর বীজ পরিষ্কার করে পুনরায় রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা ৫ থেকে ৭ শতাংশে কমিয়ে আনতে হবে।
‘তারপর শুষ্ক ও ছায়াযুক্ত স্থানে বীজ ঠান্ডা করে বায়ুরোধক পলিথিন ব্যাগ, টিন অথবা প্লাস্টিকের পাত্রে ভরে শুকনো জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে।’
বাংলাদেশে পেঁয়াজ চাষে বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই জাতের পেঁয়াজ চাষের জন্য হালকা বুনটের মাটি বেশি উপযোগী। পলি, পিলি দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও দো-আঁশ মাটিবিশিষ্ট উঁচু জমি, যেখানে পানি জমে না বা নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে, এমন জমিতে ফলন ভালো হয়।
‘আমাদের এসব দিকনির্দেশনা মেনে কৃষকরা পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হলে বাংলাদেশের উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে দেশের চাহিদা মিটবে৷ এর ফলে পেঁয়াজের দাম কমার পাশাপাশি বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে’-বলেন নতুন দুই জাতের উদ্ভাবক।
বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘ডাল ও তেলজাতীয় শস্য যেমন সয়াবিন, সরিষা, মসুর, সূর্যমুখী ছাড়াও আলু, টম্যাটো, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ শাকসবজি চাষের জমিগুলো এই নতুন জাতের পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি উপযোগী।
১৫ বছরের গবেষণা
গ্রীষ্মকালে পেঁয়াজ উৎপাদন করতে ২০০৬ সাল থেকে গবেষণা শুরু হয়। প্রথমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ জাত বারি পেঁয়াজ-২-এর বীজে গামা রশ্মি প্রয়োগ করা হয়।
এরপর পেঁয়াজের বংশগতিতে স্থায়ী পরিবর্তনের মাধ্যমে বিপি২/৭৫/২ ও বিপি২/১০০/২ নামক দুটি মিউট্যান্ট পাওয়া যায়। পরে কৃষক ও মাঠপর্যায়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়, মিউট্যান্ট দুটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাতৃজাত বারি পেঁয়াজ-২ ও চেকজাত বারি পেঁয়াজ-৩-এর চেয়ে বেশি কন্দ ও বীজ উৎপাদনে সক্ষম।
এগুলোর কন্দের সংরক্ষণকাল স্বাভাবিক অবস্থায় দুই মাস বা তার চেয়ে বেশি এবং একই বছর বীজ থেকে বীজ উৎপাদন করা হয়, যা দেশে প্রচলিত জাতে এমনটি দেখা যায় না।
ফলে মিউট্যান্ট দুটিকে জাতীয় বীজ বোর্ড ২০১৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে খরিফ-১ মৌসুমে চাষাবাদের জন্য বিনাপেঁয়াজ -১ ও বিনাপেঁয়াজ-২ নামে অনুমোদন দেয়।