শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

নরসুন্দরদের এখন বড় দুর্দিন

নাপিত, নরসুন্দর, কেশবিন্যাসকারী, ক্ষুরী, পরামানিক, ক্ষৌরকার, ক্ষৌরিক এরকম বিভিন্ন নামে আমরা যাদেরকে চিনি, চুলদাড়ি কেটে ছেঁটে পুরুষদেরকে যারা আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে ভালো নেই সেই পেশার মানুষ এখন তাদের বড় দুর্দিন চলছে। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার আনাচে কানাচে নাপিত পেশায় বংশ পরম্পরায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রেখেছিলেন এক শ্রেণির মানুষ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর কেউ নতুন করে এই পেশায় আসতে চাইছে না। যারা বর্তমানে আছেন তারাও চাননা তাদের বংশধরেরা এই পেশায় আসুক। ফলে নতুন কারিগর তৈরি হচ্ছে না। ঝুঁকির মুখে আছে ঐতিহ্যবাহী, নিত্য প্রয়োজনীয় এই নাপিত শিল্প।
যশোরের ঝিকরগাছা পৌরসভায় সেলুনের দোকান আছে ৬৬টি। এই দোকান গুলোতে এক বছর আগেও কাজ করতেন ১৩৫ জন নাপিত। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা ১১০ এর কাছাকাছি। কেনো কমছে নাপিতের সংখ্যা, কেনইবা নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না এই প্রশ্নের উত্তর দেন ঝিকরগাছা সেলুন মালিক সমিতির উপদেষ্টা আঃ কাদের। তিনি জানান এই পেশায় ভালোভাবে কাজ শিখতে একজন মানুষের সময় লাগে ৩ থেকে ৪ বছর। শিক্ষানবীস এই সময়ে আয় রোজগার হয়না। ফ্রী কাজ শিখতে হয়। কেউ এখন আর ফ্রী সময় দিয়ে কাজ শিখতে আগ্রহী নয়। যেখানে অন্য যেকোনো পেশায় শ্রমিক হিসেবে কাজ না জানলেও টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া এই পেশায় বয়স বেশি হলে তার কাছে কাস্টমার আসতে চায়না। ফলে বৃদ্ধ বয়সে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়। তাই নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না। সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর হোসেন জানান, এই পেশার মানুষকে সমাজের মানুষ নীচু জাতের বলে মনে করে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে গেলেও অন্য পেশার মানুষ আমাদের সাথে তাদের ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে চাইনা। ঝিকরগাছা বাজারের প্রবীণ নাপিত মোমিন বলেন আমরাই মানুষকে সুন্দর দেখাতে সাহায্য করি অথচ মানুষ আমাদের ভালো চোখে দেখেনা। বয়স হয়েছে তাই এখন খরিদদারও বেশি আসেনা, এজন্য আমি আমার পরিবারের কাউকে এই পেশায় আনিনি। উপজেলা মোড়ের নরসুন্দর বাবলু জানান, এখন আর আয় রোজগার তেমন একটা হয়না। সবাই ব্যস্ত। একটা কাজ করতে করতে আর একটা খদ্দের আসলে সে আর অপেক্ষা করেনা, অন্য দোকানে চলে যায়। বাবলুর মত অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে চাইছে। এবিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্প সাহিত্য গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন উদ্দীন হোসেন এর সাথে।  তিনি জানান বাংলায় এই পেশা চালু হয় সামন্ত আমলে। সেই সমাজে এদের অবস্থান ছিল নিম্নবর্গীয়। ইদানিংকালেও সেই বর্গীয় ব্যবস্হা থেকে এরা মুক্ত হতে পারেনি। বর্তমান সামন্ত ব্যবস্হার পরিবর্তে পুজিঁবাদী ব্যবস্হা চালু হয়েছে কিন্তু পেশাগত বিষয়টি এখনো এদেশে পুজিঁতান্ত্রিক রূপ পায়নি।  ইউরোপে এই ব্যবসা পুঁজিবাদে রূপ নিয়েছে। এই কারণে এই পেশার লোকজন  এখনো এদেশে হীনমন্যতায় ভুগছে। উচিৎ হচ্ছে এ পেশাকে নব্যরূপে শিল্পিত করে তোলা, আধূনিকায়ন করা ও অর্থবিনিয়োগ করা। নাপিত একটি পেশাজীবি পদবী। এই পদবী যেহেতু নিম্নবর্গের এবং নিম্নবর্ণের,সেই হেতু সমাজের এই কর্মভিত্তিক লোকজন নিজেরা নিজেদেরকে ছোটজাত হিসেবে  ভাবছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এরকম চিন্তা করা উচিৎ নয়।
লেখকঃ আশরাফুজ্জামান বাবু 
সিনিয়র সহকারী শিক্ষক 
ঝিকরগাছা দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা,
ঝিকরগাছা, যশোর।  

নরসুন্দরদের এখন বড় দুর্দিন

প্রকাশের সময় : ০২:২৩:৫৬ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ জুন ২০২২
নাপিত, নরসুন্দর, কেশবিন্যাসকারী, ক্ষুরী, পরামানিক, ক্ষৌরকার, ক্ষৌরিক এরকম বিভিন্ন নামে আমরা যাদেরকে চিনি, চুলদাড়ি কেটে ছেঁটে পুরুষদেরকে যারা আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করে ভালো নেই সেই পেশার মানুষ এখন তাদের বড় দুর্দিন চলছে। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলার আনাচে কানাচে নাপিত পেশায় বংশ পরম্পরায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রেখেছিলেন এক শ্রেণির মানুষ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এখন আর কেউ নতুন করে এই পেশায় আসতে চাইছে না। যারা বর্তমানে আছেন তারাও চাননা তাদের বংশধরেরা এই পেশায় আসুক। ফলে নতুন কারিগর তৈরি হচ্ছে না। ঝুঁকির মুখে আছে ঐতিহ্যবাহী, নিত্য প্রয়োজনীয় এই নাপিত শিল্প।
যশোরের ঝিকরগাছা পৌরসভায় সেলুনের দোকান আছে ৬৬টি। এই দোকান গুলোতে এক বছর আগেও কাজ করতেন ১৩৫ জন নাপিত। কিন্তু বর্তমানে সেই সংখ্যা ১১০ এর কাছাকাছি। কেনো কমছে নাপিতের সংখ্যা, কেনইবা নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না এই প্রশ্নের উত্তর দেন ঝিকরগাছা সেলুন মালিক সমিতির উপদেষ্টা আঃ কাদের। তিনি জানান এই পেশায় ভালোভাবে কাজ শিখতে একজন মানুষের সময় লাগে ৩ থেকে ৪ বছর। শিক্ষানবীস এই সময়ে আয় রোজগার হয়না। ফ্রী কাজ শিখতে হয়। কেউ এখন আর ফ্রী সময় দিয়ে কাজ শিখতে আগ্রহী নয়। যেখানে অন্য যেকোনো পেশায় শ্রমিক হিসেবে কাজ না জানলেও টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া এই পেশায় বয়স বেশি হলে তার কাছে কাস্টমার আসতে চায়না। ফলে বৃদ্ধ বয়সে অনিশ্চিত জীবন যাপন করতে হয়। তাই নতুন কেউ এই পেশায় আসতে চাইছে না। সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর হোসেন জানান, এই পেশার মানুষকে সমাজের মানুষ নীচু জাতের বলে মনে করে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে গেলেও অন্য পেশার মানুষ আমাদের সাথে তাদের ছেলেমেয়ে বিয়ে দিতে চাইনা। ঝিকরগাছা বাজারের প্রবীণ নাপিত মোমিন বলেন আমরাই মানুষকে সুন্দর দেখাতে সাহায্য করি অথচ মানুষ আমাদের ভালো চোখে দেখেনা। বয়স হয়েছে তাই এখন খরিদদারও বেশি আসেনা, এজন্য আমি আমার পরিবারের কাউকে এই পেশায় আনিনি। উপজেলা মোড়ের নরসুন্দর বাবলু জানান, এখন আর আয় রোজগার তেমন একটা হয়না। সবাই ব্যস্ত। একটা কাজ করতে করতে আর একটা খদ্দের আসলে সে আর অপেক্ষা করেনা, অন্য দোকানে চলে যায়। বাবলুর মত অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে চাইছে। এবিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্প সাহিত্য গবেষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা হোসেন উদ্দীন হোসেন এর সাথে।  তিনি জানান বাংলায় এই পেশা চালু হয় সামন্ত আমলে। সেই সমাজে এদের অবস্থান ছিল নিম্নবর্গীয়। ইদানিংকালেও সেই বর্গীয় ব্যবস্হা থেকে এরা মুক্ত হতে পারেনি। বর্তমান সামন্ত ব্যবস্হার পরিবর্তে পুজিঁবাদী ব্যবস্হা চালু হয়েছে কিন্তু পেশাগত বিষয়টি এখনো এদেশে পুজিঁতান্ত্রিক রূপ পায়নি।  ইউরোপে এই ব্যবসা পুঁজিবাদে রূপ নিয়েছে। এই কারণে এই পেশার লোকজন  এখনো এদেশে হীনমন্যতায় ভুগছে। উচিৎ হচ্ছে এ পেশাকে নব্যরূপে শিল্পিত করে তোলা, আধূনিকায়ন করা ও অর্থবিনিয়োগ করা। নাপিত একটি পেশাজীবি পদবী। এই পদবী যেহেতু নিম্নবর্গের এবং নিম্নবর্ণের,সেই হেতু সমাজের এই কর্মভিত্তিক লোকজন নিজেরা নিজেদেরকে ছোটজাত হিসেবে  ভাবছে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে এরকম চিন্তা করা উচিৎ নয়।
লেখকঃ আশরাফুজ্জামান বাবু 
সিনিয়র সহকারী শিক্ষক 
ঝিকরগাছা দারুল উলুম কামিল মাদ্রাসা,
ঝিকরগাছা, যশোর।