জীবনের চলার পথে প্রতিবন্ধকতা আসবেই। সেই প্রতিবন্ধকতাকে ভেধ করে কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলার মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করার নামই জীবন যুদ্ধ। আর নাম এবং জীবনের পাশে প্রতিবন্ধী শব্দটি যুক্ত হলে সেই মানবযন্ত্রটির বাস্তব জীবন হয়ে উঠে প্রতিবন্ধকতা যুক্ত দুর্বিষহ। আর সেই প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে যারা জীবনে সফল হয়েছে তারাই প্রকৃত জীবন যোদ্ধা। সেইসব সফল জীবন যোদ্ধাদের পথের দিকে অগ্রসর হওয়ার দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে আমি এগিয়ে চলছি।
আমার নাম মোঃ রকিবুল ইসলাম। আমি আমার বাবা মোঃ হাসমত আলী ও মাতা ইয়াসমিন আক্তারের একমাত্র সন্তান। আমার পৃথিবীতে ভুমিষ্ঠ হওয়ার ঘটনাটি ছিলো একটু অন্যরকম। সময়টি ছিলো ১২ জুন ১৯৮৯ সাল ঈদের দ্বিতীয় দিন। বেশির ভাগ অভিজ্ঞ ডাক্তার ছুটিতে ছিলো। এমনই ছুটির দিনে ফর্সেফ ডেলিভারির মাধ্যমে আমার জন্ম হয়। আর সেই জুন মানের খরতাপের প্রবাহে আমার জীবনও হয় উত্তপ্ত। জন্মের পরে আমার জ্ঞান ছিলো না, রাখা হয়েছিলো কাচের সেফটি ক্লাসের ভিতর।সবাই ভেবেছিলো আমি আর বাঁচবো না। তবে স্রষ্টার অশেষ কৃপায় আমি সেই যাত্রায় বেঁচে যায়। কিন্তু তখনও আমার স্বজনরা বুঝতে পারে নি আমার জীবন প্রতিবন্ধকতাময় হবে।
আমার বয়স যখন দেড় বছর তখন আমার বাবা মা ও অন্যান্য স্বজনরা বুঝতে পারল আমার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক নয়। ফলে আমার ডানপাশ অকার্যকর হয়ে পরে এবং তার ৬০% মেধা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এই তথ্যের ভিত্তিতে আমার বাবা-মা এবং নানু আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যায়।
আমার বয়স যখন ৭ বছর তখন আমি একটু একটু একা হাটতে পারি। তখন থেকে আমি আমার বাবার সাথে স্কুলে যাওয়া শুরু করি। আমি যখন চতুর্থ শ্রেণি হতে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে উত্তীর্ণ হয় তখন আমি ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পাওয়া স্বর্থেও কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নানু আনোয়ারা বেগমের একান্ত প্রচেষ্টায় ফরিদপুর শহরের সুনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ময়েজউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে আমার ভর্তি হওয়ার সুযোগহয়। ২০০৫ সাল এই বিদ্যালয়ের অধীনে আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। তখন আমাকে দ্রুতলিখার জন্য মেঝেতে বসে বাম পায়ের সাপোর্ট নিতে হতো। ফলে আমার প্রয়োজন পরে সিকবেড। কিন্তু সুনির্দিষ্ট আইনম না থাকার করণে আমি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। পরে অনেক চেষ্টা করার পর কবির বাগ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আমার নানু আনোয়ারা বেগমের প্রচেষ্টায় অতিরিক্ত ফি দিয়ে আমি মেঝেতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ অবশেষে আমি এসএসসি পরীক্ষায় সফল ভাবে কৃতকার্য হয়ে ফরিদপুর সিটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। এই সময় নাগরিক লাইব্রেরী কর্তৃক প্রকাশিত একশজন সংগ্রামী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জীবনের গল্প সম্মিলিত গ্রন্থ ”আমরা করবো জয়” এ অদম্য রকি শিরোনামের আমার জীবনের গল্প প্রকাশিত হয়। ফলে আমি সাড়া দেশে ভিন্ন রূপে পরিচিতি লাভ করি। এই সময় আমি অনুভব করি যে, চারপাশে আমার মতো অনেক মানুষ সুযোগের অভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে সমাজে নানা কুসংস্কার বিরাজমান।তখন আমার মনে হয় হয় আমার মা বাবা সচেতন বিঁধায় আমি শত বাধা ভেদ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারছি। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি গণ এইটুকু সুযোগ থেকে বঞ্চিত। তাদের মধ্যে এটিএম মোসলেহ উদ্দিন, বিপ্লব কুমার মালো, রমজান আলী, তামান্না আক্তার, জলি, সামসুল আলম, তোফাজ্জেল ঠাকুর, মাহমুদা আক্তার, তপন দাস অন্যতম। আমরা সকলে মিলে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করি ফরিদপুর বহুমূখী প্রতিবন্ধী কল্যাণ সংস্থা। শুরুতে আমি প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০১০ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক নিবন্ধীত হওয়ার পর আমি সহকারি সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয় এবং ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করি। এই সময়ে আমি ফরিদপুরের প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পৃক্ত আইন যেমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩, নিউরো ডেভেলোপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন ২০১৫ বাস্তবায়নে জরালো ভুমিকা পালন করি। আমার নেতৃত্বে ৭ সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিনিধি দল ফরিদপুর শহরে প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকল্পে কার্যক্রম পরিচালনা করি। যার ফলস্স্রুতিতে আজ প্রায় সরকরি ভবন গুলোতে র্যাম তৈরি হচ্ছে। প্রায় ৪৫০০ জন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত ফান্ড থেকে সহযোগীতা করেছি। বর্তমানে আমি উক্ত সংগঠনের আইটি পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। আমি জার্নি টু এক্সেসিবিলিটি নামে প্রবেশগম্যতা বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ করি যা এখনো চলমান আছে। উক্ত কর্মসূচীতে ১২ জন সেচ্ছাসেবক কাজ করে। আমি প্রথম আলো বন্ধু সভা, গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার, সুফি পাঠাগার এর সদস্য। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট ফান্ডে বাংলাদেশ প্রতিন্ধী উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ক কর্মসূচীতে কাজ করছি। আমি জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদ, জাতীয় প্রতিবন্ধী কল্যান ফরাম, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ কম্পিটার কাউন্সিল, ন্যাশনাল আইটি ডেভেলোপমেন্ট প্রকল্প থেকে তথ্য-প্রযুক্তি, সংগঠন পরিচালনা ও নেতৃত্ব বিষয়ক বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছি। ২০১৪ সালে স্নাতক সম্পূর্ণ করার করার পর সরকারি চাকুরি না পাওয়াই আমি আমার পারিবারিক ব্যবসায় মনোনিবেশ করি।
আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত রকি পোল্ট্রি ফার্মের পরিচালক হিসেবে কাজ করছি। উক্ত ফার্মে প্রথমে ৬০০০ হাজার সোনালি মুরগীর ক্যাপাসিটি ছিলো আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তা বর্ধিত হয়ে ২১০০০ সোনালি মুরগী ক্যাপসিটি হয়েছে। উক্ত ফার্মে দুইজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ মোট আটজন ব্যক্তির কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। ইতিমধ্যে রকি পোল্ট্রি ফার্ম ফরিদপুর জেলার ভিতর সর্ববৃহৎ সোনালি মুরগির খামার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।