শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ব্যাক টু ব্যাক এলসির পাওনা পরিশোধ ডলারের পরিবর্তে টাকায় প্রদানের প্রস্তাব

ঢাকা বুরো ।।  ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার পর  পাওনা পরিশোধ ডলারের পরিবর্তে  টাকায় প্রদানের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

টাকায় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির প্রস্তাব চলছে।  আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে হিমশিম খাচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। আগের বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নতুন এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।  বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করে কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনার কারণে ব্যাংকগুলো পূর্ববর্তী এলসির পাওনা পরিশোধের শর্ত দিয়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলাও বন্ধ করে দিয়েছে।  উল্লেখ্য, মূল এলসি জানামত রেখে অর্থ সংগ্রহের মধ্যবর্তী পদ্ধতি ব্যাক টু ব্যাক এলসি হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে, ডলার সংকট নিরসনে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রার পাচার ঠেকাতে সর্র্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি প্রকৃত মূল্যে আমদানি ঋণপত্র খোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শিশুখাদ্য, গম, চিনি, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর আমদানি যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃৃদ্ধি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্য (খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত) মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ডলারের সংকট চলছে। গত এপ্রিল থেকে এ সংকট ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও ব্যাংকগুলোর ডলার সংগ্রহের উৎসে ভাটা পড়ায় সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে রিজার্ভেও ক্রমশ চাপ পড়ছে। এ অবস্থায় তেল, গ্যাস ও সার আমদানির বাইরে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে কোনো ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।

এ ছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সৃষ্ট স্বীকৃত বিলের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক এ নির্দেশনা না মানলে এডি লাইসেন্স বাতিলসহ জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া ডলার সংকটের অজুহাতে অত্যাবশ্যকীয় অনেক পণ্যের এলসি খুলতেও অনীহা দেখাচ্ছেন।

দেশের ব্যাংকগুলো পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ও কাঁচামাল আমদানির কোনো এলসি খুলছে না বলে অভিযোগ করে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠায় ফিড ইন্ড্রাস্টিজ অ্যাসোসিয়েশন (এফআইএ)। সংগঠনটির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদের স্বাক্ষরে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের আপামর মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের কোনো বিকল্প নেই। পুষ্টিকর এ খাদ্যগুলো উৎপাদনের জন্য প্রাণিখাদ্যের প্রয়োজন। এ খাদ্য তৈরিতে যেসব অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ডলার-সংকটের কারণে অনেক পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে সরকার। এর পাশাপাশি বেশ কিছু পণ্যকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে যে সর্বোচ্চ সিলিং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা ‘অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত’ পণ্যের ঋণপত্র খুলতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের ঋণপত্র খোলার আবেদন গ্রহণ করছে না। চিঠিতে উপকরণগুলোর নাম ও এইচএস কোড উল্লেখ তা অগ্রাধিকার পণ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণপত্র খোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংগঠনটির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, ডলারের কিছুটা সংকট থাকলেও এলসি খোলা বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে। বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত ডলার সহায়তা দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।

ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে উল্লেখ করে ডলারের পরিবর্তে টাকায় স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। এ বিষয়ে গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বেই চলছে ডলার সংকট, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ঋণপত্র খোলা এবং এর মূল্য পরিশোধে ডলারের চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের রপ্তানি খাত। নিট সেক্টরের শতকরা ৮০ শতাংশ কাচামাল দেশীয় পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান ডলার সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে ঋণপত্র খোলা এবং এর মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশি টাকায় ঋণপত্র খোলা হলে এ সংকট মোকাবিলা কিছুটা হলেও সহজতর হবে বলে আমরা মনে করছি। এ ছাড়া ঋণপত্র ক্রয় এবং মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ডলার কনভার্সনের নীতিগত প্রক্রিয়ার কারণে আমরা ডলার প্রতি যে ৭-৮ টাকার বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, তা থেকেও পরিত্রাণ পাব বলে আশা করছি।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডলারের পরিবর্তে টাকায় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির সুযোগ দেওয়া হলে সংকট কিছুটা হলেও কমবে। কারণ আমাদের নিট খাতের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয় উৎস্য থেকে সংগ্রহ করা হয়। তা হলে বাকি ২০ শতংশ কাঁচামালে পেমেন্টের জন্য খুব বেশি ডলারের প্রয়োজন হবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নিষেধ করা হয়নি এমনটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলেও গত মাসে এমন একটি সার্কুলার করা হয়েছে, যেটার কারণে এলসি খোলা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ এই সার্কুলার পাওয়ার পর ব্যাংকগুলো হাত-পা গুটিয়ে বসে গেছে। আমাদের ব্যাক টু ব্যাক কোনো এলসি খুলছে না, বলছে আগের পেমেন্ট দিতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরাও বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে যথাসময়ে পেমেন্ট পাচ্ছি না। দুই মাস আগের শিপমেন্টের পেমেন্ট এখনো পাইনি, তা হলে ব্যাক টু ব্যাকের পেমেন্ট দেব কোথা থেকে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের দামের ব্যবধান অভিন্ন করার দাবিও জানান তিনি।

ব্যাংক এমডিদের দুই নির্দেশ গভর্নরের : গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএমএসএসমই খাতের জন্য গঠিত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ওপর বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেও ডলার সংকট নিরসণে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার রোধে পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের এলসি খোলা বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন গভর্নর আবদুর রউফ তালকদার। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পণ্যের প্রকৃত বাজারমূল্য যথাযথভাবে যাচাই করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এলসি খোলার কারণে দেশ কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। তা ছাড়া কোনো কোনো আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কারণেও সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। অন্যদিকে অবৈধভাবে হুন্ডি ব্যবসার ফলে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এলসি খোলার ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে শিশুখাদ্য, গম, চিনি, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর আমদানি যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।

২৮ ঘন্টা বাঘের ডেরায়, রাত কেটেছে উচুঁ কেওড়া গাছের ডালে

ব্যাক টু ব্যাক এলসির পাওনা পরিশোধ ডলারের পরিবর্তে টাকায় প্রদানের প্রস্তাব

প্রকাশের সময় : ০৮:৪৮:৫৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ নভেম্বর ২০২২

ঢাকা বুরো ।।  ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার পর  পাওনা পরিশোধ ডলারের পরিবর্তে  টাকায় প্রদানের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে।

টাকায় ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির প্রস্তাব চলছে।  আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে হিমশিম খাচ্ছে বেশিরভাগ ব্যাংক। আগের বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নতুন এলসি খোলা বন্ধ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো।  বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে এলসি খোলার দিকনির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করে কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনার কারণে ব্যাংকগুলো পূর্ববর্তী এলসির পাওনা পরিশোধের শর্ত দিয়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলাও বন্ধ করে দিয়েছে।  উল্লেখ্য, মূল এলসি জানামত রেখে অর্থ সংগ্রহের মধ্যবর্তী পদ্ধতি ব্যাক টু ব্যাক এলসি হিসেবে পরিচিত।

অন্যদিকে, ডলার সংকট নিরসনে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রার পাচার ঠেকাতে সর্র্বোচ্চ সতর্কতার পাশাপাশি প্রকৃত মূল্যে আমদানি ঋণপত্র খোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া শিশুখাদ্য, গম, চিনি, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর আমদানি যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃৃদ্ধি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলসহ সব ধরনের পণ্য (খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত) মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ডলারের সংকট চলছে। গত এপ্রিল থেকে এ সংকট ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ে কিছুটা লাগাম টানা গেলেও ব্যাংকগুলোর ডলার সংগ্রহের উৎসে ভাটা পড়ায় সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে রিজার্ভেও ক্রমশ চাপ পড়ছে। এ অবস্থায় তেল, গ্যাস ও সার আমদানির বাইরে রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোকে কোনো ডলার সহায়তা দেওয়া হচ্ছে না।

এ ছাড়া গত মাসের শেষ সপ্তাহে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে সৃষ্ট স্বীকৃত বিলের মূল্য যথাসময়ে পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোনো ব্যাংক এ নির্দেশনা না মানলে এডি লাইসেন্স বাতিলসহ জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো মাস্টার এলসির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া ডলার সংকটের অজুহাতে অত্যাবশ্যকীয় অনেক পণ্যের এলসি খুলতেও অনীহা দেখাচ্ছেন।

দেশের ব্যাংকগুলো পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ও কাঁচামাল আমদানির কোনো এলসি খুলছে না বলে অভিযোগ করে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠায় ফিড ইন্ড্রাস্টিজ অ্যাসোসিয়েশন (এফআইএ)। সংগঠনটির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদের স্বাক্ষরে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের আপামর মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের কোনো বিকল্প নেই। পুষ্টিকর এ খাদ্যগুলো উৎপাদনের জন্য প্রাণিখাদ্যের প্রয়োজন। এ খাদ্য তৈরিতে যেসব অত্যাবশ্যকীয় কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়, তার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে চলমান ডলার-সংকটের কারণে অনেক পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে সরকার। এর পাশাপাশি বেশ কিছু পণ্যকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আমদানি ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে যে সর্বোচ্চ সিলিং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বেঁধে দেওয়া হয়েছে, তা ‘অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত’ পণ্যের ঋণপত্র খুলতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে পোলট্রি, মৎস্য ও প্রাণিখাদ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। কারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের ঋণপত্র খোলার আবেদন গ্রহণ করছে না। চিঠিতে উপকরণগুলোর নাম ও এইচএস কোড উল্লেখ তা অগ্রাধিকার পণ্যে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণপত্র খোলার জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সংগঠনটির সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জিএম আবুল কালাম আজাদ আমাদের সময়কে বলেন, ডলারের কিছুটা সংকট থাকলেও এলসি খোলা বন্ধে কোনো নির্দেশনা জারি করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। সক্ষমতা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো এলসি খুলছে। বাজারের চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত ডলার সহায়তা দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দেবে।

ব্যাংকগুলো ডলার সংকটে এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে উল্লেখ করে ডলারের পরিবর্তে টাকায় স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে নিটওয়্যার মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ। এ বিষয়ে গত ৬ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, বিশ্বমন্দার প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বেই চলছে ডলার সংকট, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ঋণপত্র খোলা এবং এর মূল্য পরিশোধে ডলারের চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের রপ্তানি খাত। নিট সেক্টরের শতকরা ৮০ শতাংশ কাচামাল দেশীয় পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান ডলার সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে ঋণপত্র খোলা এবং এর মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশি টাকায় ঋণপত্র খোলা হলে এ সংকট মোকাবিলা কিছুটা হলেও সহজতর হবে বলে আমরা মনে করছি। এ ছাড়া ঋণপত্র ক্রয় এবং মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের পরিবর্তে বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে ডলার কনভার্সনের নীতিগত প্রক্রিয়ার কারণে আমরা ডলার প্রতি যে ৭-৮ টাকার বিশাল অঙ্কের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি, তা থেকেও পরিত্রাণ পাব বলে আশা করছি।

চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম আমাদের সময়কে বলেন, ‘ডলারের পরিবর্তে টাকায় এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির সুযোগ দেওয়া হলে সংকট কিছুটা হলেও কমবে। কারণ আমাদের নিট খাতের ৮০ শতাংশ কাঁচামাল স্থানীয় উৎস্য থেকে সংগ্রহ করা হয়। তা হলে বাকি ২০ শতংশ কাঁচামালে পেমেন্টের জন্য খুব বেশি ডলারের প্রয়োজন হবে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এলসি খুলতে ব্যাংকগুলোকে নিষেধ করা হয়নি এমনটি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হলেও গত মাসে এমন একটি সার্কুলার করা হয়েছে, যেটার কারণে এলসি খোলা এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ এই সার্কুলার পাওয়ার পর ব্যাংকগুলো হাত-পা গুটিয়ে বসে গেছে। আমাদের ব্যাক টু ব্যাক কোনো এলসি খুলছে না, বলছে আগের পেমেন্ট দিতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরাও বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে যথাসময়ে পেমেন্ট পাচ্ছি না। দুই মাস আগের শিপমেন্টের পেমেন্ট এখনো পাইনি, তা হলে ব্যাক টু ব্যাকের পেমেন্ট দেব কোথা থেকে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের দামের ব্যবধান অভিন্ন করার দাবিও জানান তিনি।

ব্যাংক এমডিদের দুই নির্দেশ গভর্নরের : গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সিএমএসএসমই খাতের জন্য গঠিত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমের ওপর বাণিজ্যিক ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকেও ডলার সংকট নিরসণে আমদানি ও রপ্তানির আড়ালে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার রোধে পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধারণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের এলসি খোলা বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন গভর্নর আবদুর রউফ তালকদার। তিনি বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো পণ্যের প্রকৃত বাজারমূল্য যথাযথভাবে যাচাই করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এলসি খোলার কারণে দেশ কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। তা ছাড়া কোনো কোনো আমদানির ক্ষেত্রে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের কারণেও সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। অন্যদিকে অবৈধভাবে হুন্ডি ব্যবসার ফলে দেশ বৈদেশিক মুদ্রা প্রাপ্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এলসি খোলার ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং না হয়, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সঙ্গে শিশুখাদ্য, গম, চিনি, ডাল, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর আমদানি যেন কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে।