বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কর -মহনবী রাসুল (সা.)

ইসলাম একটি সর্বজনীন ও আদর্শ জীবনবিধান। ব্যক্তির বিনির্মাণ ও সফলতায় ইসলামি বিধান পরিপালন খুবই সহজ—কারণ তার প্রতিটি শিক্ষা ও নির্দেশনা মানব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সহায়ক। ইসলামি জীবন দর্শন ও শরিয়তের দেখানো পথ অনুসরণে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
ইসলামি জীবনবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মা-বাবার অধিকার নিশ্চিত করা, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ ও ভালোবাসা এবং স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচ্য নয়। ইসলাম প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানে গুরুত্বারোপ করে।
হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ৭৩)। অন্যকে সালাম দেওয়া মানে তার শান্তি কামনা করা। এখানে ছোট বড়কে, কালো ফর্সাকে, গরিব ধনীকে সালাম দেবে—এমন কথা বলা হয়নি; বরং সবাই সবাইকে সালাম দেবে। এতে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
মানুষের সঙ্গে বসবাস, চলাফেরা ও সদ্ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের থেকে পাওয়া বেদনাদায়ক বিষয়াবলির ওপর ধৈর্য ধারণ করে, সে ওই মুসলমান থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ যে একাকী জীবনযাপন করে এবং মানুষের বেদনাদায়ক কথায় ধৈর্য ধারণ করে না।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২৫০৭)।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ (আল মুজামুল কাবির লিত-তাবারানি, হাদিস: ২৯৮)। মহানবী (সা.) বলেন, নিজের মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার তোমাদের জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৯৫৬)।
ইসলামে বিশেষত মা-বাবার সঙ্গে সদাচার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পৃথিবীতে আগমনের প্রকাশ্য মাধ্যম তারা। এজন্য ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতায় বাবা-মায়ের মর্যাদা ও সম্মানের মহত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে একাধিক নির্দেশনা এসেছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, বাবা জান্নাতের দরজাগুলোর মধ্যে মধ্যবর্তী দরজা। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ২৭৯৯)। তিনি আরও বলেন, বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৮৯৯)
বড়দের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে নওজোয়ান কোনও বয়স্ক ব্যক্তিকে তার বয়সের কারণে সম্মান করবে, আল্লাহতায়ালা তার বার্ধক্যেও এমন মানুষ তৈরি করে দেবেন, যে তাকে সম্মান করবে ও তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২০২২)।
রাসুল (সা.) অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের সম্মান করে না, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৯১৯)।
প্রতিবেশী ও স্বজনদের খেয়াল রাখা এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাসুল (সা.) বলেন, সে তো মুমিনই নয়, যে নিজে পেটপুরে খেলো কিন্তু তার প্রতিবেশী অভুক্ত রইলো। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ৭৩০৭)।
আল্লাহর রাসুল আরও বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম প্রতিবেশী হলো ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিবেশীর কাছে উত্তম। (সহি ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫১৮)।
বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা সদাচারের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এর বিপরীত; অর্থাৎ অসাদাচরণের শামিল। যারা বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, ইসলামে তাদের কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫৯৮৪)।
সমাজ সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের ওপর টিকে থাকে। আর এগুলোর মূল উপাদান যখন অনুপস্থিত থাকে, তখন সমাজে ফাটল দেখা দেয়। ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের শক্তিশালী উপাদান হলো আত্মত্যাগ ও কোরবানি। এজন্য পবিত্র কোরআনে আত্মত্যাগের প্রশংসা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘…আর তারা (আনসাররা) তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিররা) নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না কেন।…’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)।
এটি প্রাচীন ইসলামি সভ্যতা ও মুসলিম সমাজের ওইসব গুণাবলির ছোট্ট একটি গুণ, যেটি সেই সোনালি সমাজের অংশ ছিল। এ কারণেই অপরিচিত দুটি দল; আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সুতরাং আমাদেরও উচিত সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা—এতে ইসলামি জীবনাদর্শ পরিপালনের জন্য যেমন আমরা আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবো, তেমনি দুনিয়ায় আল্লাহ আমাদের সম্মানের মতো মহাদৌলত দান করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সদ্ব্যবহারকারী হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।

মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কর -মহনবী রাসুল (সা.)

প্রকাশের সময় : ০৮:৩৪:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০২২

ইসলাম একটি সর্বজনীন ও আদর্শ জীবনবিধান। ব্যক্তির বিনির্মাণ ও সফলতায় ইসলামি বিধান পরিপালন খুবই সহজ—কারণ তার প্রতিটি শিক্ষা ও নির্দেশনা মানব প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও সহায়ক। ইসলামি জীবন দর্শন ও শরিয়তের দেখানো পথ অনুসরণে জীবনের সব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
ইসলামি জীবনবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মা-বাবার অধিকার নিশ্চিত করা, বড়দের শ্রদ্ধা, ছোটদের স্নেহ ও ভালোবাসা এবং স্বজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার ইত্যাদি। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি বিবেচ্য নয়। ইসলাম প্রত্যেককে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানে গুরুত্বারোপ করে।
হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পরস্পর সালাম বিনিময় করো’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস: ৭৩)। অন্যকে সালাম দেওয়া মানে তার শান্তি কামনা করা। এখানে ছোট বড়কে, কালো ফর্সাকে, গরিব ধনীকে সালাম দেবে—এমন কথা বলা হয়নি; বরং সবাই সবাইকে সালাম দেবে। এতে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে।
মানুষের সঙ্গে বসবাস, চলাফেরা ও সদ্ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের থেকে পাওয়া বেদনাদায়ক বিষয়াবলির ওপর ধৈর্য ধারণ করে, সে ওই মুসলমান থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ যে একাকী জীবনযাপন করে এবং মানুষের বেদনাদায়ক কথায় ধৈর্য ধারণ করে না।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২৫০৭)।
তিনি আরও বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ (আল মুজামুল কাবির লিত-তাবারানি, হাদিস: ২৯৮)। মহানবী (সা.) বলেন, নিজের মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার তোমাদের জন্য সদকাস্বরূপ।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৯৫৬)।
ইসলামে বিশেষত মা-বাবার সঙ্গে সদাচার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পৃথিবীতে আগমনের প্রকাশ্য মাধ্যম তারা। এজন্য ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতায় বাবা-মায়ের মর্যাদা ও সম্মানের মহত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে একাধিক নির্দেশনা এসেছে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, বাবা জান্নাতের দরজাগুলোর মধ্যে মধ্যবর্তী দরজা। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ২৭৯৯)। তিনি আরও বলেন, বাবার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং বাবার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহর অসন্তুষ্টি। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৮৯৯)
বড়দের সঙ্গে উত্তম আচরণ ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, যে নওজোয়ান কোনও বয়স্ক ব্যক্তিকে তার বয়সের কারণে সম্মান করবে, আল্লাহতায়ালা তার বার্ধক্যেও এমন মানুষ তৈরি করে দেবেন, যে তাকে সম্মান করবে ও তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২০২২)।
রাসুল (সা.) অন্যত্র ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ছোটদের স্নেহ এবং বড়দের সম্মান করে না, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ১৯১৯)।
প্রতিবেশী ও স্বজনদের খেয়াল রাখা এবং তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাসুল (সা.) বলেন, সে তো মুমিনই নয়, যে নিজে পেটপুরে খেলো কিন্তু তার প্রতিবেশী অভুক্ত রইলো। (আল মুসতাদরাক আলাস-সাহিহাইন, হাদিস: ৭৩০৭)।
আল্লাহর রাসুল আরও বলেন, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে উত্তম প্রতিবেশী হলো ওই ব্যক্তি, যে আপন প্রতিবেশীর কাছে উত্তম। (সহি ইবনে হিব্বান, হাদিস: ৫১৮)।
বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক রাখা সদাচারের অন্তর্ভুক্ত এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা এর বিপরীত; অর্থাৎ অসাদাচরণের শামিল। যারা বন্ধু ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, ইসলামে তাদের কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারি শরিফ, হাদিস: ৫৯৮৪)।
সমাজ সম্প্রীতি, ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের ওপর টিকে থাকে। আর এগুলোর মূল উপাদান যখন অনুপস্থিত থাকে, তখন সমাজে ফাটল দেখা দেয়। ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহারের শক্তিশালী উপাদান হলো আত্মত্যাগ ও কোরবানি। এজন্য পবিত্র কোরআনে আত্মত্যাগের প্রশংসা করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘…আর তারা (আনসাররা) তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিররা) নিজেদের ওপর অগ্রাধিকার দেয়, নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না কেন।…’ (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)।
এটি প্রাচীন ইসলামি সভ্যতা ও মুসলিম সমাজের ওইসব গুণাবলির ছোট্ট একটি গুণ, যেটি সেই সোনালি সমাজের অংশ ছিল। এ কারণেই অপরিচিত দুটি দল; আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে চমৎকার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
সুতরাং আমাদেরও উচিত সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা—এতে ইসলামি জীবনাদর্শ পরিপালনের জন্য যেমন আমরা আল্লাহর কাছে পুরস্কৃত হবো, তেমনি দুনিয়ায় আল্লাহ আমাদের সম্মানের মতো মহাদৌলত দান করবেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সদ্ব্যবহারকারী হিসেবে কবুল করে নিন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।