
দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স অর্থাৎ গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গতকাল শনিবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। বিকাল ৫টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ বা সত্য উন্মোচন শিরোনামের এ প্রতিবেদন তুলে দেন। এতে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগের মধ্যে ৭৫৮ জনের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ গত ১৫ বছরে দেশে সংঘটিত গুমের ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার প্রশাসনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি গুমের অভিযোগ এসেছে র্যাব, ডিজিএফআই, ডিবি ও সিটিটিসির বিরুদ্ধে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরুসহ র্যাব বিলুপ্তিরও সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
গুম কমিশন সূত্র জানিয়েছে, কোন সংস্থা কতটি গুম করেছে, কোন কোন কর্মকর্তা এ কাণ্ডে জড়িত ছিলেন, কীভাবে গুম করা হতো, কীভাবে বন্দি করে রাখা হতো এবং গুমের পর কতজনকে পরবর্তীকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছেÑ প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে। গুমকাণ্ডে শেখ হাসিনা ছাড়াও সম্পৃক্ত অন্যান্য কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
প্রতিবেদন দাখিলের পর গুম কমিশনের প্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, গুমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা কাজটি এমনভাবে করেছেন, যাতে এগুলো শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যায়। বিভিন্ন ফোর্স নিজেদের মধ্যে ভিকটিম বিনিময় করেছে এবং ভিন্ন ভিন্নভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। তিনি আরও জানান, গুমের শিকার অনেকে এখনও শঙ্কামুক্ত হতে
পারছেন না। তাদের ওপর এতটাই ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছিল যে তারা এখনও ট্রমায় ভুগছেন।
প্রধান উপদেষ্টা তার সর্বশেষ বক্তব্যে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষা ও সঠিক বিচারের আশ্বাস দেওয়ার পর রিপোর্টের সংখ্যা অনেক বেড়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সদস্যরা অধ্যাপক ইউনূসকে আয়নাঘর পরিদর্শনের অনুরোধ জানান। তারা বলেন, আপনি আয়নাঘর পরিদর্শন করলে ভিকটিমরা অভয় পেতে পারেন। প্রধান উপদেষ্টা তাদের এ অনুরোধে সম্মতি দিয়ে জানান, স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল যা আয়নাঘর নামে পরিচিতি পেয়েছে, সেগুলো দেখতে যাবেন। তিনি কমিশন সদস্যদের অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং কাজটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
কমিশনপ্রধান মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তারা তিন মাস পর মার্চে আরও একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন দেবেন। কাজটি শেষ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে কমপক্ষে আরও এক বছর সময় প্রয়োজনÑ জানান তিনি।
কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী, মানবাধিকারকর্মী নূর খান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাবিলা ইদ্রিস ও মানবাধিকার কর্মী সাজ্জাদ হোসেন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।
শেখ হাসিনার শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর কমিশন ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, গোয়েন্দা সংস্থা, তদন্ত সংস্থাসহ সরকারের মদদে হওয়া গুমের তথ্য সংগ্রহ শুরু করে। ৩ অক্টোবর গুলশান কার্যালয়ে কমিশনের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ডিজিএফআই কার্যালয়ে গিয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান মিলেছে। আয়নাঘর নামে পরিচিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলটি (জেআইসি) ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরেই। ওই আয়নাঘরে বন্দি রাখার ২২টি সেল রয়েছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব বন্দিশালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আয়নাঘরখ্যাত গোপন বন্দিশালায় আটকে রাখা হতো। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আয়নাঘরের কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গুম কমিশনের সদস্যরা ডিজিএফআইর বন্দিশালায় পরিদর্শনে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ নষ্টের প্রমাণও পান। দেয়ালের লেখাগুলো পেইন্ট করে মুছে দেওয়া হয়েছে। উত্তরা র্যাব-১ কার্যালয়সহ র্যাবের বেশ কয়েকটি ব্যাটালিয়নে গোপন বন্দিশালা থাকার তথ্য পেয়েছে গুম কমিশন। বন্দিশালাগুলোর কোনো পরিবর্তন না করার জন্য র্যাবকে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
গত বৃহস্পতিবার র্যাবের মহাপরিচালক শহিদুর রহমান এক সাংবাদিক সম্মেলনে র্যাবের গুম-খুনের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলেন, গুম কমিশনের নির্দেশে আমরা বন্দিশালাগুলোর কোনো পরিবর্তন পরিবর্ধন করিনি।
২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় পার্বত্য চট্টগ্রামকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের সংগঠক মাইকেল চাকমাকে। পাঁচ বছরের বেশি সময় বন্দি থাকার পর ৬ আগস্ট মুক্তি পান তিনি। তার ভাষ্য, ঢাকা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ের বন্দিশালায় তাকে রাখা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট রাতে আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে গুম করা হয়। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর তাকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তির পর আবদুল্লাহিল আমান আযমী জানান, তাকেও একই বন্দিশালায় আটকে রাখা হয়েছিল।
২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর বনানীতে নিজ বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে। ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও এ পর্যন্ত তার কোনো হদিস মেলেনি। ২০১০ সালের ২৫ জুন গুমের শিকার হন তৎকালীন ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৫৬ নম্বর (বর্তমান ঢাকা দক্ষিণের ২০) ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম। তাকে ফার্মগেট ইন্দিরা রোড থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও চৌধুরী আলমের খোঁজ পায়নি তার পরিবার।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্য মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে দেশে ৬৭৭ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯৮ জন গুমের শিকার হন ২০১৮ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এ ছাড়া ২০০৯ সালে তিনজন, ২০১০ সালে ১৯, ২০১১ সালে ৩২, ২০১২ সালে ২৬, ২০১৩ সালে ৫৪, ২০১৪ সালে ৩৯, ২০১৫ সালে ৬৭, ২০১৬ সালে ৯০, ২০১৭ সালে ৮৮, ২০১৯ সালে ৩৪, ২০২০ সালে ৩১, ২০২১ সালে ২৩, ২০২২ সালে ২১ ও ২০২৩ সালে ৫২ জন গুমের শিকার হন।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গুম কমিশনের জমা দেওয়া তথ্য বলছে, কমিশন এ পর্যন্ত ১ হাজার ৬৭৬টি অভিযোগ পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে যে হিসাব রয়েছে, প্রকৃতপক্ষে গুমের সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি, কমিশনে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যাই সেটা প্রমাণ করে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মহসিন মিলন
সম্পাদকীয় পরিষদ
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: নুরুজ্জামান লিটন, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: রোকনুজ্জামান রিপন, নির্বাহী সম্পাদক: আব্দুল লতিফ, যুগ্ন নির্বাহী সম্পাদক: আলহাজ্ব মতিয়ার রহমান, সহকারী সম্পাদক: সাজ্জাদুল ইসলাম সৌরভ, মামুন বাবু, বার্তা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম
সম্পাদকীয় কার্যালয়
বার্তা ও বানিজ্যক কার্যালয়: গাজীপুর আবাসিক এলাকা, বেনাপোল, যশোর। ইমেইল: mohsin.milon@gmail.com, bartakontho@gmail.com ফোন: ৭৫২৮৯, ৭৫৬৯৫ মোবা: ০১৭১১৮২০৩৯৪
All Rights Reserved © Barta Kontho