প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ২, ২০২৫, ১২:০৫ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ মে ২৪, ২০২৫, ১০:১৯ এ.এম

লেখক: আব্দুল্লাহ আল নোমান
কোনো জাতির ইতিহাসে কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের চিন্তা, চেতনা ও কর্মের আলো যুগ যুগ ধরে সেই জাতিকে পথ দেখায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে এমনই এক আলোকবর্তিকা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম—বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহের প্রতীক, প্রেম ও মানবতার অমোঘ কণ্ঠস্বর। তাঁর জীবন যেমন কষ্টের, সংগ্রামের, তেমনি তাঁর সাহিত্য বিপ্লব ও ভালোবাসার মেলবন্ধন। নজরুল জয়ন্তীর এই বিশেষ মুহূর্তে আমরা ফিরে তাকাবো সেই দুরন্ত, দুঃসাহসী কবির দিকে, যাঁর কলম এক সময় কাপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, যাঁর গান এখনো জাগায় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
শৈশবের সংগ্রাম: দুর্দশা থেকে দুরন্তপনার পথে: ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। পিতা কাজী ফকির আহমদ ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন। অল্প বয়সেই বাবাকে হারানো নজরুলের জীবনে নেমে আসে প্রচণ্ড দারিদ্র্য। সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয় খুব ছোট বয়সেই। কখনো রুটির দোকানে কাজ করেছেন, কখনো মসজিদে আযান দিয়েছেন। এমনকি লেটো দলে যোগ দিয়ে গান, কবিতা ও নাটকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। এখানেই বপন হয় তাঁর শিল্প-সাহিত্যের বীজ।
সেনাজীবন ও সাহিত্যচর্চার সূচনা: ১৯১৭ সালে নজরুল যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। করাচিতে পোস্টিং থাকা অবস্থায়ও তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন। এই সময়েই তাঁর লেখা গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেতে শুরু করে। করাচি থেকেই তাঁর সাহিত্যিক আত্মপ্রকাশের যাত্রা, যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে পরিণত হয়।
কলকাতায় ফেরা ও সাহিত্যজগত কাঁপানো আবির্ভাব:
সেনা জীবন শেষ করে ১৯২০ সালে নজরুল ফিরে আসেন কলকাতায় এবং পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’—যেখানে স্থান পায় কালজয়ী ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই কবিতা ছিল বাঙালির ইতিহাসে এক সাহসী চিৎকার—
“আমি চিরদ্রোহী, আমি বিশ্ব-বিধাত্র"
এটি শুধুমাত্র একটি কবিতা নয়, বরং ছিল উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এক জাতির ঘোষণা। বাংলার যুবসমাজ যেন নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করল নজরুলের কলমে।
এই সময় থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক।
সাহিত্যের বিস্তৃত জগৎ: নজরুলের প্রতিভা কোনো একক ধারায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি ছিলেন বহুপ্রজ, বহুধারার সাহিত্যিক। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গানে উঠে এসেছে প্রেম, বিদ্রোহ, মানবতা, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সাম্যবাদের গভীর বোধ।
উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে—
কবিতা: বিদ্রোহী, ধুমকেতু, প্রলয়োল্লাস, কামাল পাশা।
উপন্যাস: বাঁধনহারা,কুহেলিকা,মৃত্যুক্ষুধা।
প্রবন্ধ: যাদের আমি ভালোবাসি, ধর্ম ও মানবতা।
নাটক: ঝিলিমিলি, পুতুলের বিয়ে।
গান: প্রায় ৪০০০ গান, যার মধ্যে রয়েছে ইসলামি গান, শ্যামা সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান এবং প্রেমের গান
তিনি একই সঙ্গে লিখেছেন মুসলিম গজল—
"তোরা দেখে যা আযানের ধ্বনি, ভেঙে গিয়েছে গোরার ঘুম"
আবার লিখেছেন শ্যামাসঙ্গীত—“করুণাময়ী কালী মা”।
এই অসাধারণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নজির আজও বিরল।
ধর্ম, সাম্য ও মানবতা: নজরুলের অন্তরের আকুতি:
নজরুল এমন সময়ের মানুষ, যখন ধর্মীয় ভেদাভেদ সমাজে তীব্র আকার ধারণ করছিল। কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থানে—সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক সাহসী কণ্ঠ হিসেবে।
তিনি স্পষ্ট লিখেছেন—
"মোরা এক বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান!”
এই মানবতাবাদী চেতনা তাঁর সমস্ত সাহিত্যকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। আমার মনে হয়, আজকের ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার যুগে নজরুল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।
রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাহিত্যিক প্রতিবাদ:
নজরুল কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন এক রাজনৈতিক চিন্তাবিদ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্র করেছেন। ১৯২২ সালে তাঁর লেখা প্রবন্ধ ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ এবং কবিতা ‘ভাঙার গান’ ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাঁকে কারাগারে পাঠায়। জেলে বসে তিনি লিখেন—
“মিথ্যা রোষে কারারুদ্ধ করেছো আমায়, সত্যের জোয়ার থামানো যাবে না।”
এই সাহসী কণ্ঠ, এই প্রতিবাদী মনোভাব আজকের তরুণদের জন্য এক অনন্য প্রেরণা।
প্রেম, সৌন্দর্য ও জীবনদর্শনের কবি: নজরুল শুধুমাত্র বিদ্রোহের কবি নন, তিনি প্রেমেরও কবি। তাঁর প্রেমিক মন ছুঁয়ে গেছে নারী, প্রকৃতি, জীবন ও ঈশ্বরকে। তাঁর কবিতা ও গানে যে গভীর আবেগ, তা পাঠককে অন্তরের গভীরে নাড়া দেয়—
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আজ যে গানে গাই, সে গান তোমায় শোনাবো”
এই প্রেমিক কবি দুঃখকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করেছেন। তাঁর জীবনে আসা স্ত্রী প্রমীলা এবং তাঁর প্রতি নজরুলের অগাধ ভালোবাসা তাঁর অনেক গানের প্রেরণা হয়েছে।
বাকরুদ্ধ জীবন ও করুণ পরিণতি: ১৯৪২ সালে নজরুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি এক ধরনের স্নায়ুবিক জটিলতায় বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। প্রায় তিন দশক তিনি সাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন। ভারত সরকার ও কিছু শুভানুধ্যায়ীর চেষ্টায় তাঁকে চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠানো হয়, কিন্তু তেমন উন্নতি হয়নি।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর কবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে অবস্থিত—যেখানে তিনি চেয়েছিলেন কবর হোক, যেন আজান শুনতে পান।
নজরুল আমার চোখে:
জাতীয় কবি কেন আজও প্রাসঙ্গিক আজকের এই সময়ে, যখন সমাজে বিভাজন, অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় উগ্রতা বাড়ছে, তখন নজরুলের উদারতা, মানবতাবাদ ও বিদ্রোহী চেতনা একান্ত প্রয়োজন। তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে কলম হতে পারে শোষণের বিরুদ্ধে অস্ত্র, কিভাবে গান হতে পারে ভালোবাসার ভাষা, আর কিভাবে সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে এক জাতির আত্মার প্রতিফলন।
নজরুল জয়ন্তী আমাদের সামনে নিয়ে আসে আত্মসচেতন হওয়ার, নতুন করে ভাবার, নতুন করে গড়ার সুযোগ। আজ যখন আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করি, তখন এই কথাটি বারবার মনে রাখতে হবে—নজরুলকে সম্মান জানাতে হলে শুধু তাঁর কবিতা মুখস্থ করলেই হবে না, তাঁর চেতনায় বাঁচতে হবে, তাঁর আদর্শে জীবন গড়তে হবে।
"তিনি গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন সাহসের, প্রেমের, মানবতার এক অমূল্য ধন—যা আমাদের জাতির সম্পদ হয়ে থাকবে চিরকাল।”
লেখক পরিচিতি:
আব্দুল্লাহ আল নোমান
ডিআইইউ,রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও একজন সাহিত্যপ্রেমী,
যিনি নজরুল চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহিত্যচর্চা করেন।