প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ৫, ২০২৫, ১০:৪৪ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ অগাস্ট ২৬, ২০২৫, ১২:৪২ পি.এম

শূন্য মরুভূমির বুক চিরে বয়ে যাওয়া উত্তপ্ত বাতাস, আকাশজোড়া নীলিমা আর ধুলোমাখা প্রান্তরের মাঝেই লেখা হচ্ছিল মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সুন্দর গল্পটির প্রারম্ভিক অধ্যায়। ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ, ইয়াউমুল ফিল, হাতির বছর। মক্কার বুকে জন্ম নিলেন সেই শিশু, যিনি পরবর্তীতে সমগ্র মানবতার মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবেন, মুহাম্মদ ইবনু আবদুল্লাহ।
কিন্তু নবজাতক শিশুটির ভাগ্যে তখনও সহজতা আসেনি। জন্মের আগেই তিনি পিতৃহীন। মা আমিনার কোলে সীমাহীন স্নেহ থাকলেও, মক্কার রীতি অনুযায়ী এই অনাথ শিশুটিকে মরুভূমির বিশুদ্ধ বাতাস ও শুদ্ধ ভাষার শিক্ষা পেতে পাঠানো হলো বদর বনু সাদ অঞ্চলে। আর সেখানেই শুরু হলো এক আবেগময় অধ্যায়, যেখানে এক দরিদ্র কিন্তু স্নেহময়ী নারী, হজরত হালিমা সাদিয়া রা., নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের প্রথম শিক্ষিকা ও লালনকারীর ভূমিকা পালন করলেন।
বদর বনু সাদ: বিশুদ্ধ বাতাস ও শুদ্ধ ভাষার জনপদ
মক্কার চারপাশের মরুভূমিতে বিভিন্ন গোত্র বসবাস করত, কিন্তু বানু সাদ গোত্রটি বিশেষ খ্যাত ছিল। এখানে মানুষের চরিত্র ছিল দৃঢ়, ভাষা ছিল বিশুদ্ধ এবং প্রকৃতি ছিল কঠিন। মক্কার অভিজাত পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কয়েক বছরের জন্য এই মরুভূমির দুধমাদের কাছে পাঠাত। কারণ মরুভূমির বিশুদ্ধ বাতাস, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং সুন্দর ভাষা শিশুদের দেহ ও মনকে গঠন করত। ইবনু হিশাম, সিরাতুন নবাবিয়্যা: ১/১৬৫
এক স্নেহময়ী মায়ের আগমন
হজরত হালিমা সাদিয়া রা.এবং তাঁর স্বামী হারিস ইবনু আবু জুয়াইব, সঙ্গে ছোট শিশু,তাদের জীবনে তখন দরিদ্র্যের গভীর ছায়া। ক্ষুধা, পিপাসা, এবং দুর্বল উটের যাত্রা নিয়ে তারা মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন, যেখানে দুধমা হিসেবে শিশু গ্রহণের আশায় বহু নারী এসেছিল। কিন্তু ছোট্ট মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে কেউই নিতে চাইছিল না। কেননা তিনি অনাথ, কোনো ধনী অভিভাবক নেই। শেষ মুহূর্তে হালিমা রা. স্বামীকে বললেন, চলো, এই শিশুটিকে আমরা নিয়ে যাই। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের জন্য এতে বরকত রেখেছেন। এ সিদ্ধান্তই বদলে দিল তাঁদের পুরো জীবন।
বরকতের স্রোতধারা
নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে গ্রহণ করার পর থেকে হালিমা রা.এর জীবনে একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটতে লাগল,
১. আগে ক্ষুধার্ত থাকা উটটি নবজীবন পেয়ে দ্রুত চলতে শুরু করল। ২.শুকিয়ে যাওয়া স্তনে হঠাৎ দুধ প্রবাহিত হলো।৩.ঘরে ছাগলগুলো প্রচুর দুধ দিতে শুরু করল।
হালিমা রা. নিজেই বর্ণনা করেন, যে দিন আমি মুহাম্মদকে কোলে নিলাম, আমাদের ঘরে দারিদ্র্যের অন্ধকার কেটে গেল। আল্লাহ এমন বরকত দিলেন, যা এর আগে কখনো সে দেখিনি।(ইবনু সাদ, তাবাকাতুল কুবরা:১/১০৯)
নবীজির চারটি স্বর্ণালী বছর
হালিমা সাদিয়ার ঘরে কাটানো চার বছর ছিল নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের নির্মলতম সময়। মরুভূমির সেই খোলা আকাশের নিচে, বিশুদ্ধ বাতাস ও প্রাকৃতিক পরিবেশে, ছোট্র মুহাম্মদ বেড়ে উঠছিলেন সুস্থ, শক্তিশালী ও সুন্দর চরিত্রবান এক শিশু হিসেবে।
এই সময়ে তিনি শিখেছেন
১. শুদ্ধ আরবি ভাষা, যা পরবর্তীতে তাঁর ওহির ভাষা হবে। ২.ধৈর্য ও সহনশীলতা,যা মরুভূমির কঠিন জীবনের পাঠ। ৩.স্নেহ ও সম্পর্কের মূল্য,যা হালিমার রা. ভালোবাসায় শিখলেন।
হৃদয় চিরে ফেরেশতার পরিশুদ্ধকরণ (শক্কুস-সদর)
হালিমার ঘরে নবীজির জীবনে ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা। একদিন নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেলছিলেন। তখন হজরত জিবরাইল আ.এসে তাঁর বুক চিরে, হৃদয় বের করে জমজমের পানি দিয়ে ধুয়ে, পুনরায় বসিয়ে দেন। (সহিহ মুসলিম: ২৬২) এ ঘটনার পর হালিমা ভয়ে মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -কে মক্কায় ফিরিয়ে দেন। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে নবীজির প্রতি ভালোবাসা চিরস্থায়ী থেকে যায়।
নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর স্নেহ ও কৃতজ্ঞতা
বড় হওয়ার পরও নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হালিমা সাদিয়াকে কখনো ভুলে যাননি। যখনই হালিমা তার কাছে আসতেন, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে যেতেন। নিজের চাদর বিছিয়ে দিতেন। সাহাবারা তাঁকে আমাদের নবীর মা বলে সম্মান করতেন। (ইবনে হিশাম:১/ ১৭৫)
বদর বনু সাদের বুকে নবীজির সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লালন-পালন ছিল শুধু ইতিহাস নয়, বরং আল্লাহর হিকমতের এক মহামূল্যবান নিদর্শন। হালিমা সাদিয়া রা.এর স্নেহ, ত্যাগ ও ঈমানের গল্প আমাদের শিখিয়ে দেয় যে, অনাথ শিশুটিও আল্লাহর কৃপায় বিশ্বনেতা হতে পারে। মরুভূমির সেই নিস্তব্ধ রাতগুলো, তারার আলোয় ভরা আকাশ, মৃদু হাওয়ার স্পর্শ আর হালিমার আঁচলে নবীজির হাসি—সব মিলিয়ে বদর বনু সাদের চারটি বছর ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রস্তুতকৃত এক বিশেষ পাঠশালা। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল এক আলো ছড়িয়ে দেওয়ার যাত্রা, যা আজও মানবতার অন্তরে জ্বালিয়ে রেখেছে তৌহিদের প্রদীপ। --সময় সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক: মহসিন মিলন
সম্পাদকীয় পরিষদ
সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি: নুরুজ্জামান লিটন, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: রোকনুজ্জামান রিপন, নির্বাহী সম্পাদক: আব্দুল লতিফ, যুগ্ন নির্বাহী সম্পাদক: আলহাজ্ব মতিয়ার রহমান, সহকারী সম্পাদক: সাজ্জাদুল ইসলাম সৌরভ, মামুন বাবু, বার্তা সম্পাদক: নজরুল ইসলাম
সম্পাদকীয় কার্যালয়
বার্তা ও বানিজ্যক কার্যালয়: গাজীপুর আবাসিক এলাকা, বেনাপোল, যশোর। ইমেইল: mohsin.milon@gmail.com, bartakontho@gmail.com ফোন: ৭৫২৮৯, ৭৫৬৯৫ মোবা: ০১৭১১৮২০৩৯৪
All Rights Reserved © Barta Kontho