প্রিন্ট এর তারিখঃ ডিসেম্বর ৮, ২০২৫, ৫:৫৮ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ ডিসেম্বর ৮, ২০২৫, ১:৪০ পি.এম
ইতিহাসে বিচারব্যবস্থায় ন্যায়পরায়ণতার, সর্বোচ্চ দৃষ্টান্ত হিসেবে যাঁর নাম সর্বাগ্রে আসে, তিনি হলেন, মানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তিনি শুধু একজন ধর্মীয় নেতা নন, বরং রাষ্ট্রনায়ক, প্রশাসক এবং অনন্য বিচারকও ছিলেন। তাঁর রায় ছিল ন্যায়, সত্য, করুণা এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের মিশেল। বন্ধুত্ব, জাতি, ধর্ম, কোনো পক্ষপাতিত্ব তাঁর বিচারকে প্রভাবিত করতে পারেনি। আজকের যুগে বিচারব্যবস্থার নানা জটিলতা, প্রভাবশালী শ্রেণির আধিপত্য এবং দুর্নীতি আমাদেরকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়, নবীজির ন্যায়পরায়ণ বিচারশাসনই মানবজগতের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, ছিলেন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও নিষ্ঠাবান বিচারক। তিনি বিচারকার্য পরিচালনা করতেন আল্লাহর নির্দেশিত নীতির ওপর ভিত্তি করে। কোরআনে আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফের পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকারী, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্য প্রদানকারী হয়ে যাও। যদিও তা তোমাদের নিজেদের বা পিতা-মাতা ও আত্মীয়বর্গের বিপক্ষে হয়। সে( অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য) ধনী হোক বা দরিদ্র। আল্লাহ উভয় প্রকার ব্যক্তির (তোমাদের চেয়ে বেশি) হিতাকাঙ্খী। অতএব তোমরা ইনসাফ করার বিষয়ে, অন্তরের খেয়াল খুশির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা জিহ্বা ঘুরাও, অথবা এড়িয়ে যাও তবে আল্লাহ তোমাদের সকল কাজকর্ম সম্বন্ধে সম্যক অবহিত। (সূরা নিসা, আয়াত :১৩৫)
এই আয়াতের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ছিল নবীজির জীবনে। সিরাতের বিভিন্ন গ্রন্থে রয়েছে- কাবার দেয়ালে হাজারে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে কোরাইশরা যখন মতবিরোধে লিপ্ত হয়। তখন তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে। তারপর নবীজি তাদের মাঝে ইনসাফের সঙ্গে ফায়সালা করেন। অথচ তখন তার গোত্র বনো হাশেমও শরিক ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ছিলেন আপোসহীন। কোনো সম্পর্ক বা প্রভাব তার ন্যায়বিচারকে বধাগ্ৰস্ত করতে পারতো না। একবার মাখজুম গোত্রের এক চোর নারীর ঘটনা কোরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল, এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে?
তার বলল, একমাত্র রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয়তম উসামা বিন যায়েদ রাযিয়াল্লাহু আনহু এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা রাযিয়াল্লাহু আনহু নবীজির সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন "তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমালঙ্ঘকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ?" এরপর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বললেন, "তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কারণেই ধ্বংস করা হয়েছে যে, যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে যখন কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক চুরি করত, তখন তার ওপর শাস্তি প্রয়োগ করত" আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম! (বোখারি : ৩৪৭৫)।
এটি প্রমাণ করে, ন্যায়বিচারে কোনো সম্পর্ক বা প্রভাব তার সিদ্ধান্তকে নত করতে পারেনি।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক বিচারব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন, যেখানে ছিল না কোনো পক্ষপাতিত্ব, স্বজন প্রীতি ও ক্ষমতার দাপট। ছিল সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সর্বগ্রাহ্য ও যুক্তিসঙ্গত প্রমাণাদি ও ইনসাফের মানদণ্ডে সমৃদ্ধ। তার বিচার ব্যবস্থায় মুসলিম-অমুসলিম ধনী-গরীব বন্ধু-শত্রু প্রভাবশালী ও প্রভাবশালী ইত্যাদি সকলের মাঝে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তার কাঠগড়ায় একজন সাধারণ মানুষকে যেমন দাঁড়াতে হতো। ঠিক তেমনই একজন নেতাকেও দাঁড়াতে হতো।
হাদিস শরিফে আছে। একবার একজন মুসলিম ও একজন অমুসলিম নালিশ নিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে গেল। উভয়ের জবানবন্দী সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে, মুসলিম লোকটি দোষী বলে প্রমাণিত হলো। তাই রায় গেল, অমুসলিম লোকটির পক্ষে। এ ব্যাপারে মুসলিম লোকটি অখুশি হয়ে মামলাটি আবার ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে পেশ করল। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু নালিশ ও বিচারের আদ্যোপান্ত অবহিত হলেন। এবং মুসলমান ব্যক্তিটিকে হত্যা করেন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজে ন্যায়বিচারের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। শুধু সমাজেই নয়, তিনি সাহাবাদের হৃদয়েও ন্যায়, ইনসাফ ও সততার বীজ রোপণ করেছিলেন। তাই ইতিহাসের সোনালি পাতায় দৃষ্টি দিলেই দেখা যায়, সাহাবিদের বিচারব্যবস্থায় সর্বত্রই সেই ন্যায়বিচার ও ইনসাফের দীপ্তিময় ছাপ। তাদের এই আদর্শ আচরণ দেখে ,বহু অমুসলিম সত্যের সন্ধান পেয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
এমনকি আজও ইসলামের প্রকৃত ধারক বাহক ওলামা মাশায়েখের বিচার ব্যবস্থায় নবীজির সেই ন্যায়বিচার ও ইনসাফের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই।
আর যেসব বিচারক ন্যায়সঙ্গত ফায়সালা না করে। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়। এবং জালেমের পক্ষে রায় দেয়, নবীজি তাদের জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বিচারক তিন প্রকার, একপ্রকার বিচারক জান্নাতী। আর অপর দুই প্রকার বিচারক জাহান্নামী। জান্নাতি বিচারক হলো, যে সত্যকে বুঝে তদনুযায়ী ফায়সালা দেয়। আর যে বিচারক সত্যকে জানার পরে স্বীয় বিচারে জুলুম করে, সে জাহান্নামী। এবং যে বিচারক অজ্ঞতাপ্রসূত ফায়সালা দেয় সেও জাহান্নামী। (সুনানে আবি দাউদ:৩৫৭৩)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যখনই কোনো বিচার আসত। তিনি দ্রুত সময়ে ফায়সালা করতেন। কখনো বিচারকে ঝুলিয়ে রাখতেন না।
আমরা জানি ও বিশ্বাস করি, একটি সমাজ ও রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন , সে দেশের বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসন সঠিক থাকা। যে দেশের বিচার ব্যবস্থা ঠিক নেই, সেই দেশ এমনিতে ভেঙে পড়ে। আজ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ, আমাদের বিচার ব্যবস্থা পরিপূর্ণ সঠিক না থাকা।
আমাদের বিচার চলে ক্ষমতার দাপটে। যার ক্ষমতা রয়েছে রায় চলে তার পক্ষে। আদালতে যখন কোন মামলা পেশ করা হয়, তখন সম্মানিত বিচারকদের রায় শুনাতে, বছরের পর বছর বিলম্ব ও সঠিক বিচার না করার কারণে, একদিকে যেমন আসামিরা বিচারের পরোয়া করে না। ঠিক অপরদিকে সাধারণ জনতা দিন দিন আইনের উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলছে।
ফলে সমাজে অপরাধ নির্মূল হওয়ার পরিবর্তে, বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমাজের প্রতিনিয়ত চুরি, ডাকাতি,খুন,ধর্ষণ যার জ্বলন্ত উদাহরণ। এই পরিস্থিতি আমাদের স্পষ্ট করে মনে করিয়ে দেয়, যে আদর্শ বিচারব্যবস্থা নবীজি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা আজকের আদালতে কঠোরভাবে প্রয়োজন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারক হিসেবে ছিলেন ন্যায়, সত্য, মানবিকতা ও আল্লাহভীতির প্রতিচ্ছবি। তাঁর আদালতে কোনো পক্ষপাত ছিল না, তাঁর রায়ে কোনো অন্যায়ের অবকাশ ছিল না। আধুনিক বিশ্বের বিচারব্যবস্থা নানা সংকটে আক্রান্ত, আর এজন্যই নবীজির আদর্শ আমাদের সামনে পথ দেখায়।
তাই আমরা যদি নবীজির বিচারব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করি, তবে রাষ্ট্র হবে সুন্দর।সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, সত্যিকারের শান্তি ও ন্যায়। মানুষ ফিরে পাবে তাদের প্রকৃত অধিকার। এবং বিচারকগণ হবেন, আদর্শ বিচারক। যাদের নিয়ে গর্ব করবে দেশ ও জাতি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন!
--সময় সংবাদ
লেখক: শিক্ষার্থী, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম রামপুরা (বনশ্রী মাদরাসা) ঢাকা