
দেশেবিদেশে নিত্যদিন নানা ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে বুদ্ধিজীবী মহল কিংবা টিভিতে চলে টক শো। সেখানে বিশিষ্টজনেরা তুলে ধরেন নানা চুলেছেঁড়া বিশ্লেষণ। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমানতালে চলে বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, মন্তব্য। কিন্তু যেসব মানুষ যাদেরকে আমরা সাধারন বলে গণ্য করে থাকি তারা এসবের ধার ধারেননা। তারা দোকান, হাটেবাজারে কয়েকজন একত্র হলেই শুরু করে দেন ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ। যেটাকে আমরা ‘সাধারন মানুষের টক শো’ নামে অভিহিত করতে পারি!
সেদিন এক চা দোকানে বসে নাস্তা করতে গিয়ে এ রকম আলোচনা পর্বের বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করি। পাশের বেঞ্চে বসে কয়েকজন লোক সেসময়ের ঘটে চলা কী একটা ঘটনার উপর একে অপরের সাথে তর্কবিতর্ক, মন্তব্য করে চলেছেন। যদিও সেই মন্তব্য, কথা-বার্তার সাথে আমি অনেকক্ষেত্রেই একমত হতে পারছিলামনা। কিন্তু, পরবর্তিতে দেখা গেলো দোকানের ঐ টক শো’র কথাগুলো যেন সেই ঘটনার কী ফলাফল হতে পারে তার আগাম পূর্বাভাস ছিল! আমি তো হতবাক। কী দারুণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা ছিল তাদের। তখন আমার বুঝে আসে মফস্বল কিংবা শহরের সাধারন মানুষ যারা রাজনীতি, কূটনীতি জানেনা তাদের ধ্যানধারণা আসলে টিভি টক-শো’র আলোচকদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বরং তারা বিশ্লেষণ করে নিরপেক্ষভাবে, নির্ভয়ে। কারো দালালী করেনা তারা। তারা তেলবাজও নয়।
সাধারন মানুষ তাদের আবেগ, অনুভূতিগুলো নিজেদের মতো করে প্রকাশ করে। কোন চাপ বা প্রভাব তাতে কাজ করেনা। কোন সংশয়ও এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়না। যে কারণে তাদের বিশ্লেষণগুলো অনেক বেশি সুচারু, গঠনমূলক ও যৌক্তিক হয়ে থাকে। বলা চলে মজার টক শো। যারা পদলেহী হয় কিংবা চাপের কাছে মাথানত করে তাদের বিশ্লেষণ হয় একপাক্ষিক ও অনেক বেশি প্রশংসামূলক।
যদিও গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ দেশবিদেশের খবরাখবর নিয়ে তেমন ওয়াকিবহাল নন। এসব নিয়ে তাদের মাথাব্যথাও নেই। খোঁজখবর রাখেননা কোন বিষয় নিয়ে। তাছাড়া, সরকারি মিডিয়া (বিটিভি) ছাড়া বহু এলাকায় ক্যাবল নেটওয়ার্ক না থাকায় অন্য টিভিচ্যানেলও দেখার সুযোগ নেই। যে কারণে বিটিভির উপরই অনেকটা নির্ভর করতে হয়। ফলে বিস্তারিত বা বিশদভাবে খবর দেখা কিংবা শোনার সুযোগও তেমন একটা থাকেনা। এখন অবশ্য ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে সবখানে পৌঁছে যাচ্ছে খবরাখবর। বিশেষ করে ফেসবুকের কল্যাণে অনেককিছু ভাইরাল হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এগুলো নিয়ে মন্তব্য, বিশ্লেষণ করেন। তাদের সেই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে উঠে আসে সমাজের নানাদিক। ভালো, খারাপ সবকিছুকে আমলে নিয়ে তারা মূল সিদ্ধান্তে পৌঁছেন।
যারা টিভি টক শোতে অংশ নেন তাদের অনেকের মতামত, বিশ্লেষণ খুব একটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনা বা যুক্তিসংগত হয়না। তারা আলোচনায় নিজেদের দল/মতাদর্শের গুণগান গান। যেভাবেই হোক তারা নিজের মতকে বা দলের আদর্শ ও কর্মসূচির যৌক্তিকতা প্রমাণে মরিয়া হয়ে উঠেন। সাধারন মানুষ এসবের কোনকিছুর প্রতি আসক্ত হননা। তারা দল বা মতের আদর্শের উর্ধ্বে উঠে ঘটনার রহস্য কী হতে পারে তা পর্যালোচনা করেন। এতে তাদের বিশ্লেষণ দক্ষতা ধরা পড়ে। ফুটে উঠে বাস্তবতাটা। যদিও তাদের সব মতামতকে গ্রহণ করার কোন কারণ নাই। একেবারে ফেলনাও নয়। সাধারন মানুষ তাদের জীবনযাপন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। ব্যস্ত থাকে তাদের কর্ম নিয়ে। এসব নিয়ে ভাবার সময় কই। কিন্তু তাদের চিন্তাধারাকে সম্মান দেওয়া উচিত। তাদের সেই বিশ্লেষণ ক্ষমতা, দক্ষতাকে মূল্যায়ন করা উচিত বলে মনে করি। আমরা তো নিজেদের স্বার্থের বিপরীত কোনকিছু ভাবতে পারিনা। পারিনা অন্যের ভালো কাজের প্রশংসা করতে। এই অভ্যাসের কারণে আমাদের দেশের উন্নতিতেও ধীরগতি। সাধারন মানুষের কথা ভাবার যেখানে কোন ফুরসুত নেই সেখানে তাদের মতামতের মূল্যই বা কী!
যে যাই বলুক অনেকে সাধারন মানুষের ঘটনার এই বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা করি আমিও।
নজরুল/বার্তাকণ্ঠ
মোহাম্মদ খালেদ নিজাম, শিক্ষক ও কলামিস্ট 



















