
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দাবি, ইউক্রেন না কি ‘প্রকৃত স্বাধীন রাষ্ট্র’ নয়। একসময় তা রাশিয়ারই অংশ ছিল। তাই তাদের আবার ফিরিয়ে আনার ‘নৈতিক অধিকার’ রাশিয়ার আছে! সেইসঙ্গে ইউক্রেনে রুশবিরোধী ষড়যন্ত্র চলছে, আর তা প্রতিহত করাটা ‘আত্মরক্ষা’ বলেও দাবি পুতিনের। এই অজুহাতে পুতিন যদি ইউক্রেন দখলে নিতে পারেন, তাহলে তাইওয়ানের জন্যও এটি শঙ্কার কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
উল্লেখ্য, তাইওয়ানকে নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং একটি প্রদেশ বলে দাবি করে চীন। সেইসঙ্গে এখানেও পশ্চিমা ষড়যন্ত্র এবং চীনবিরোধী তৎপরতার দাবি তুলেছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। রাশিয়া যে দিন (২৪ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে আগ্রাসন চালায়, সে দিনই ৯টি চীনা যুদ্ধবিমান তাইওয়ানের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। আর ইউক্রেন ইস্যুতে যেমন শি নিশ্চুপ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে পুতিনকে সমর্থন দিয়েছেন, তেমনি তাইওয়ান ইস্যুতে রাশিয়ার সমর্থন প্রত্যাশা করতেই পারে চীন।
বিশ্লেষকরা এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া পরিস্থিতির সঙ্গে চীন-তাইওয়ানের মিল খুঁজতে শুরু করেছেন। অঞ্চল দুটির মধ্যে মিল থাকলেও, ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক পার্থক্যও রয়েছে।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। রাশিয়া ও ইউক্রেন- উভয়েরই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এবং খাদ্যাভ্যাস একে-অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ অতি প্রাচীন শহর এবং রুশ জনগোষ্ঠীর একসময়ের রাজধানী। রুশ ও ইউক্রেনীয়- উভয় জনগোষ্ঠীই দাবি করে থাকে- কিয়েভ তাদের আধুনিক সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার মূল কেন্দ্র।
জারতন্ত্রে ইউক্রেন ছিল রুশ সাম্রাজ্যের অংশ। ১৯১৭ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের একটি বড় অংশ রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন ইউক্রেন প্রজাতন্ত্র গঠনের চেষ্টা করে। নভেম্বরে বলশেভিক বিপ্লবের পর লেনিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত সরকার স্বাধীন ইউক্রেন গঠনের চেষ্টা দমন করে। ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হিসেবে ইউক্রেনের নাম হয় ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক। আজকের ইউক্রেনের মানচিত্র তৈরি হয়েছে রুশ বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার মধ্যে দিয়ে ১৯৯১ সালে জন্ম হয় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্রের।
এ কারণেই পুতিন তার ভাষণে বলেছেন, ‘ইউক্রেন কোনো দিনই প্রকৃত অর্থে একটি রাষ্ট্র ছিল না। এখন যা ইউক্রেন তা আসলে প্রাচীন রুশ ভূখণ্ড। আধুনিক যুগের এই ইউক্রেন আসলে বলশেভিক কমিউনিস্ট রাশিয়ার সৃষ্টি। ১৯১৭ সালে বিপ্লবের পর এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং লেনিন ও তার সহযোগীরা রাশিয়ার ঐতিহাসিক ভূখণ্ডকে ভাগ করে ছিঁড়ে-খুঁড়ে নিয়ে সবচেয়ে খারাপভাবে এ কাজটা করেছিলেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার সময় মিখাইল গর্বাচেভের দুর্বল সরকারের কারণেই ইউক্রেন স্বাধীন হওয়ার সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল।
অপরদিকে, হংকং, ম্যাকাও ও তাইওয়ান- এ তিনটি অঞ্চল নিয়ে ঐতিহাসিকভাবে চীনের ভেতরে ও বাইরে বিতর্ক রয়েছে। হংকং ও ম্যাকাও এখন চীনের অধীনস্থ। এই দুটি অঞ্চলের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে স্বশাসিত এলাকা হিসেবে। তবে তাইওয়ানের অবস্থা ভিন্ন। এটি কি চীনের অংশ, না কি স্বাধীন দেশ- এ নিয়ে খোদ তাইওয়ানেও বিতর্কের কমতি নেই। চীনের দাবি তাইওয়ান তারই অংশ। এটি চীন থেকে বেরিয়ে যাওয়া একটি প্রদেশ, যা ভবিষ্যতে আবারও চীনের সঙ্গে একীভূত হবে। তাইওয়ানের কোনো কোনো দল ও জনগণের একটি অংশ এটিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে দেখতে চান। আবার অনেকেই আছেন যারা চীনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পক্ষে। ১৬৮৩ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত চীনের রাজারাই শাসন করেছে তাইওয়ান। এরপর জাপানিরা দখল করে ওই দ্বীপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয় চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্বাধীন চীনা সরকারের হাতে। তবে চীনের গৃহযুদ্ধে মাও সে-তুঙয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির গণমুক্তি বাহিনীর সঙ্গে হারতে থাকে চিয়াং কাইশেকের সরকার। এক পর্যায়ে চিয়াং কাইশেক ও তার কুওমিনটাং পার্টির লোকজন পালিয়ে যান তাইওয়ানে। সেখানে তারা ‘চীন প্রজাতন্ত্র’ নামে এক সরকার গঠন করে এবং নিজেদের সমগ্র চীনের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার বলেও দাবি করে।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তাইওয়ানের সরকারই চীনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। ওই বছর জাতিসংঘ মূল ভূখণ্ডে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে বিশ্বের প্রায় সব দেশই বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। অপরদিকে, তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কমতে থাকে। ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত তীব্র বাকযুদ্ধ চললেও, পরে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তখন ‘এক দেশ, দুই পদ্ধতি’ নামে চীন এক প্রস্তাব দেয়- তাইওয়ান মূল চীনে একীভূত হবে; কিন্তু তাদের স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে। তাইওয়ান সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। অবশ্য দু’পক্ষের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকেনি। তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো চীনে প্রায় ছয় হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
তাইওয়ানের প্রায় ১০ লাখ মানুষ চীনে থাকেন। ইউক্রেনে যে জাতিগত বিরোধের বিষয় রয়েছে, তাইওয়ানের ক্ষেত্রে সেটিও বাস্তব নয়। তাইওয়ানের জনগণের ৯৮ শতাংশই হান জাতিসত্তা, যারা চীনেরও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিসত্তা, যাদের ভাষা মান্দারিন।
সম্প্রতি বেইজিং ও তাইপের মধ্যকার উত্তেজনা চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। সাই ইং-ওয়েন ২০১৬ সালে তাইওয়ানের নেতৃত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুরনো সমস্যাটি আরও তীব্র হয়েছে। চীন এ অঞ্চলটির ওপর সামরিক চাপ বাড়িয়েছে। কাছাকাছি সমুদ্রসীমায় যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। দফায় দফায় লঙ্ঘন করেছে তাইওয়ানের আকাশসীমা।
তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ‘এক চীন, এক নীতি’ তত্ত্বকে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি চীনে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার প্রক্রিয়ায় জাতীয়তাবাদ ও তাইওয়ান ইস্যুতে শি বেশি জোর দিয়েছেন। তিনি বরাবরই বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে না হলে জোর করে তাইওয়ানকে ‘মূল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে’ আনা হবে। শি ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ পুনরেকত্রীকরণের কথা বললেও আদতে তার আগ্রাসী বক্তব্যে ছিল ‘জোরপূর্বক’ দখলের হুমকি। প্রচুর যুদ্ধবিমান মোতায়েন রাখা হয়েছে তাইওয়ানের দিকে তাক করে। চীনা যুদ্ধবিমান নিয়মিতই তাইওয়ানের আকাশসীমায় প্রবেশ করছে।
তাইওয়ানের উপকূল ঘেঁষে প্রায়ই চীনের নৌবাহিনী শক্তি প্রদর্শন করে। আর এ ক্ষেত্রে তাইওয়ানের বড় ভরসা যুক্তরাষ্ট্র। তবে চীন সামরিক হস্তক্ষেপ শুরু করলে তাইওয়ানকে সামরিক সহায়তা যে যুক্তরাষ্ট্র দেবে না, তা ইউক্রেন ইস্যু থেকে স্পষ্ট। তবে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা জাগিয়ে তুলতে শি জিনপিং যে তাইওয়ান দখলে নিতে পারেন, সে শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 







































