
দৈনন্দিন জীবনে বাঙালি রান্নাঘরের অনেকটা জুড়ে আছে লবঙ্গ। লবঙ্গকে বলা যেতে পারে রান্নার প্রাণ। লবঙ্গ রান্নাকে সুগন্ধিতে ভরিয়ে দেয়। বাড়ায় স্বাদ। আবার এই লবঙ্গই যুগ যুগ ধরে আর্য়ুবেদিক চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে।আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে লবঙ্গ গাছের নানা অংশ যেমন শুকনো ফুল, ডাল এবং পাতা ব্যবহার হয়ে আসছে। আবার রান্নায় স্বাদ বাড়ানোর জন্য লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়।জনপ্রিয় মশলা লবঙ্গ হচ্ছে লবঙ্গ গাছের শুকিয়ে যাওয়া ফুল। সামান্য তরকারি হোক বা স্যুপ, বেকারি আইটেম হোক বা পায়েস, মাছ হোক বা মাংস— মশলাটির প্রয়োগে যে কোনও খাদ্যবস্তুর স্বাদহয়ে ওঠে স্বর্গীয়।লবঙ্গ গাছের ইংরেজি নাম ক্লোভ এবং বৈজ্ঞানিক নাম সিজিজিওমোরোমেটাম। লবঙ্গ গাছের ফুলের কুড়িকে শুকিয়ে তৈরি করা হয়।
লবঙ্গকে লং বলেও ডাকা হয়। লবঙ্গ গাছ ১৫ থেকে ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। বোটাসহ ফুলের কুঁড়ি শুকিয়ে গেলে লবঙ্গে পরিণত হয়। ফল ১ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়,এরা মাংসল,পাকার পরে শুকালে গাড়ো বাদামি রঙ ধারণ করে।লবঙ্গের আদিবাস ইন্দোনেশিয়ার মালুকু দ্বীপে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে লবঙ্গ ব্যবহার করা হয়। ইন্দোনেশিয়ায় এর আদিবাস হলেও বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় প্রচুর পরিমাণে লবঙ্গ উৎপাদিত হয়।রান্নাঘরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মশলা লবঙ্গের সুগন্ধের মূল কারণ ‘ইউজেনল’। এটি লবঙ্গ থেকে প্রাপ্ত তেলের মূল উপাদান, এবং এই তেলের প্রায় ৭২-৯০% অংশ জুড়ে ইউজেনল বিদ্যমান।
এই যৌগটির জীবাণুনাশক এবং বেদনানাশক গুণ রয়েছে।লবঙ্গের তেলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল অ্যাসিটাইল ইউজেনল, বেটা-ক্যারোফাইলিন, ভ্যানিলিন, ক্র্যাটেগলিকঅ্যাসিড, ট্যানিন, গ্যালোট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ফ্ল্যাভানয়েড, ইউজেনিন, ইউজেনটিন, ট্রি-টেরপেনয়েড, ক্লিনোলিক অ্যাসিড, স্টিগ্মাস্টেরল, সেস্কুইটার্পিন।১০০ গ্রাম লবঙ্গে ৬৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৬ গ্রাম প্রোটিন, ১৩ গ্রাম টোটাললিপিড, ২ গ্রাম সুগার, ২৭৪ কিলো-ক্যালোরি শক্তি ও ৩৩ গ্রাম ডায়েটারিফাইবার থাকে।লবঙ্গের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে তৈরি হওয়া ফ্রি র্যাডিক্যালস ধ্বংস করতে পারে। ফলে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সারও প্রতিরোধেও বিশেষ ভূমিকা নেয়। তাই প্রতিদিন খালি পেটে লবঙ্গ চিবালে একাধিক অসুখের আশঙ্কা কমে যায়।প্রত্যেক দিন ব্যক্তির রাতে ঘুমানোর আগে ১টি লবঙ্গ ও ১ গ্লাস গরম জল পান করলে বিভিন্ন ধরনের রোগের থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে সহজেই।
লবঙ্গ হজম প্রক্রিয়া উন্নত করতে সাহায্য করে। যেমন- গ্যাস, বমিভাব এবং বদহজমের মতো অনেক সমস্যায় লবঙ্গ খুব উপকারী।লবঙ্গ যৌন রোগে উপকারি। লবঙ্গ কামোদ্দীপক। এর সুবাস অবসাদ দূর করে, শরীর ও মনের ক্লান্তি ঝরিয়ে দেয়। নারী ও পুরুষের শারীরিক যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।লিভারে নতুন ও স্বাস্থ্যকর কোষ তৈরিতে সাহায্য করে লবঙ্গ। লিভার থেকে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতেও কার্যকরী ভূমিকা নেয়। আসলে লবঙ্গে রয়েছে থায়মল এবং ইউজেনল নামে সক্রিয় উপাদান যা লিভারকে করে তোলে শক্তিশালী।লবঙ্গ দাঁতের ব্যথা দূর করে।
মাড়ির ক্ষয় নিরাময় করে। লবঙ্গতে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন কিছু বিক্রিয়া করে যে নিমেষে দাঁতের যন্ত্রণা কমে যায়। প্রায় সব টুথপেস্টের কমন উপকরণ এই লবঙ্গ।বমি বমি ভাব দূর করে লবঙ্গ। ট্রেনে বা বাসে যাওয়ার সময় যদি মাথা ঘুরতে থাকে ও বমি এসে যায়, তাহলে মুখে একটি লবঙ্গ রেখে সেই রস চুষলে বমি ভাব ও মাথা ঘোরা কমে যাবে। গর্ভবতী মায়েরা সকালের বমিবমি ভাব দূর করতে লবঙ্গ চুষতে পারেন। লবঙ্গের সুগণ্ধ বমিবমি ভাবদূর করে।লবঙ্গ সর্দি–কাশি ও ঠাণ্ডা লাগা কমায়। সর্দিকাশির মহৌষধ হিসেবে লবঙ্গ বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লবঙ্গ চিবিয়ে রস গিলে খেলে বা লবঙ্গ মুখে রেখে চুষলে সর্দি, কফ, ঠাণ্ডা লাগা, অ্যাজমা, গলাফুলে ওঠা, রক্ত পিত্ত আর শ্বাস কষ্টে সুফল পাওয়া যায়।স্ট্রেস ও উৎকণ্ঠা দূর করে লবঙ্গ। এক টুকরো লবঙ্গ মুখে ফেলে চুষে চুষে খেয়ে ফেলুন।
পান করতে পারেন লবঙ্গের চাও। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে উঠবে।ক্যানসার প্রতিরোধ করে লবঙ্গ। বিশেষ করে ব্রেস্ট ক্যানসার, ওভারিয়ান ক্যানসার প্রতিরোধ করে থাকে। আর্থ্রাইটিসের যন্ত্রণা কমায়। লবঙ্গে উপস্থিত অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিসের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে।ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় প্রাকৃতিক দাওয়াই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে লবঙ্গ। বিশেষ করে ব্রণ, ফুসকুড়ি, ত্বকের লাবণ্য চলে যাওয়া এমনকি মাথার খুসকিও দূর করে লবঙ্গ।এছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন দাগ দূর করতে ব্যবহার করতে পারেন লবঙ্গ। যে কোনও দাগ ভ্যানিশ। মুখে তেল ছিটকে ফোসকা পড়েছে? মশার কামড়ে লাল হয়ে গেছে? লবঙ্গ তেলেই লুকিয়ে সমাধান।
লবঙ্গ তেল যে কোনও দাগ সহজেই তুলে দেয়। সেই সঙ্গে স্কিন টোন ভালো হয়। দাগ ছোপ মিলিয়ে যায়।ছত্রাক ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি রোধ করতে লবঙ্গ দারুণ কাজে দেয়। বিশেষ করে চুল পড়া কমাতে এবং চুলের সৌন্দর্য বাড়াতে লবঙ্গ তেলের জুড়ি মেলা ভার। এক্ষেত্রে আধ চামচ লবঙ্গ তেলের সঙ্গে সম পরিমাণ অলিভ অয়েল মিশিয়ে সেই মিশ্রণ চুলের গোড়ায় লাগিয়ে মিনিটদশেক মাসাজ করতে হবে।
লাইফস্টাইল ডেস্ক ।। 







































