
শরণখোলা থেকে কিছুটা দূরে সুন্দরবনের ঠিক পাশেই একটা গ্রামে বাস করেন মৃত গোলদারের ষাটোর্ধ স্ত্রী। সুন্দর বনের অপার সৌন্দর্যের বিপরীতে থাকা ভয়ংকর হিংস্রতা একদিন কেড়ে নিয়েছিলো তার স্বামীকে তার স্ত্রীর মুখ থেকে জানা যায়, দারিদ্রতার কারণে ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া করতে পারেনি গোলদার। মূলত তার পেশা ছিল সুন্দরবনের মাছ ধরা। ঘটনাটি ঘটেছিল ২৪ বছর আগে। মূল ঘটনার সূত্রপাত হয় এখান থেকে। গোলদার ছিলো সুন্দরবনের একজন সরকার অনুমোদিত জেলে। মাছ ধরা তার পেশা হলেও, একদিন সে প্রস্তাব পায় সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করার। স্থানীয় কিছু লোক এবং এলাকার বড় ভাইদের নিয়ে ১০-১৫ জন মিলে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পরে।
সাধারণত মধু সংগ্রহ করার সময় থাকে বছরে দুই মাস।দুই মাসে সে দুইবার বাড়িতে আসে প্রথমবার সে বাড়িতে আসে ২০ দিন পরে।এবং ফিরে যাওয়ার ১৫ দিন পরে বাকি সাথিদের সাথে মনোমালিন্য হবার কারণে ১৫ দিনের মাথায় আবারও বাড়িতে ফিরে আসে। বাসায় তার স্ত্রী সন্তান সবাই বোঝাই, এভাবে ফিরে আসলে সে মধুর ভাগ পাবে না কারন তখনো মধু ভাগাভাগি করা হয়নি। গোলদার পুনরায় সুন্দরবনে ফিরে যাই। সে মধু সংগ্রহ শুরু করে।
কোন এক জৈষ্ঠ্য মাসে, নদীতে তখন ভাটা ছিল গোলদাররা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করছিল, সারারাত অব¯’ানের পরে জোয়ার এলে নৌকা করে সুন্দরবনের গহীনে প্রবেশ করে। গোলদাররা ছিল ১০ থেকে ১৫ জন এবং তারা সবাই ২৫ হাত দূরে দূরে অব¯’ান করে মধু সংগ্রহ করছিল। সংগ্রহ শেষে গোলদার এক জায়গায় দিয়ে ফিরে আসার সময় লক্ষ্য করল কিছু মধু সংগ্রহ তখনো বাকি আছে।তখন তার থেকে ২৫ হাত দূরের সবথেকে কাছে যে অব¯’ান করছিল সে বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পাই এবং গোলদারকে সতর্ক করে বাকি সাথীদের সতর্ক করার জন্য উদ্যত হয়। ততক্ষণে গোলদারকে পেছন থেকে বাঘে আক্রমণ করে,তার গলা বরাবর বাঘ দুইটা দাঁত বসিয়ে দেয়।
ইতিমধ্যে বাকি সবাই বুঝতে পারে কোন এক বিপদ হয়েছে এবং গোলদারকে বাঘে আক্রমণ করেছে,সবাই চিৎকার করতে করতে গোলদারের নাম ধরে উ”চস্বরে এগিয়ে আসে। ততক্ষণে বাঘ দৌড়ে পালিয়ে যাই এবং গোলদারের চারপাশে কিছু শেয়াল তাকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে।
বাকি সাথীরা যখন তার কাছে আসে তখনও গোলদারের প্রাণ কিছুটা ছিল,এবং তাদের কোলেই সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
দিনটি ছিল রবিবার বিকাল, নদীর পাড়ে তখন ভাটা চলছিল, জোয়ার না আসা পর্যন্ত তারা নদীর ওই পাড়ে যেতে পারবেনা, গোলদারের লাশ নিয়ে তারা অপেক্ষা করছিল কখন জোয়ার আসবে।
সারারাত অপেক্ষার শেষে পর দিন সোমবার সকালে জোয়ার আসলে লাশ নিয়ে তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে নদীর ঐপাড়ে যাই। সেখানে ¯’ানীয় একটি বাজার ছিল শরণখোলা, সেখানে তাকে রাখা হয়ে।
কিছুক্ষণ পর গোলদারের স্ত্রীর কাছে আসে তারই চাচাতো ভাই, নাম হাসিম তালুকদার। গোলদারের দুটো ছেলে এবং একটি মেয়ে সন্তান ছিল।ছেলে দুটোকে নিয়ে হাশেম তালুকদার শরণখোলা বাজারের দিকে রওনা দেয়। মহিলার একটু সন্দেহ হয়। সে তাদের পিছু পিছু বাজারের দিকে যাই,এবং অনেক লোকের ভিড় দেখে কাছে গিয়ে দেখতে পাই তার স্বামীর মৃতদেহ পড়ে আছে। গ্রামের মহিলারা তাকে ধরে এক ¯’ানে বসিয়ে সান্তনা দেয়।
গ্রামে তখন কুসংস্কার ছিল স্ত্রী যদি নাকের নথ খুলে রাখে তাহলে স্বামীর অমঙ্গল হয় এই ধরনের কোন কিছু।
কাকতালীয় ভাবে গোলদার যেদিন মারা যায়,তার স্ত্রী নাকের নথটি সেই দিনই খুলে রাখে। তার স্ত্রীর ধারণা এই কারণেই তার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে।
গোলদার মৃত্যুর আগে তার স্ত্রীকে বলে রেখেছিল তার যদি মৃত্যু হয় তাহলে তার কবর যেন তার বাসায় দেওয়া হয়। মহিলার শ্বশুর মানে গোলদারের বাবা সহ সবাই যখন গোলদার কে নিয়ে কবর¯’ করতে উদ্যত হয় তখন সে পায়ে জড়িয়ে ধরে বলে তাকে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়।মহিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে।
সে এক করুন দৃশ্য যা চোখের সামনে দেখা কষ্টসাধ্য, গোলদারের স্ত্রী গোলদারের লাশ জড়িয়ে থাকে তাকে নিয়ে যেতে দেয় না। তার শ্বশুর তাকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে।অন্যরা তাকে সান্তনা
দেয়।
শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা মহিলার কথাই সম্মতি দেয় এবং বলে গোলদারের যদি নিজের কোন জমি জায়গা থাকে সেখানে গোলদারকে কবর¯’ করা হবে।শেষ পর্যন্ত তাই করা হয়। এটা ২৪ বছর আগের।
কিš‘ তার স্ত্রী এখনো আশা করে সরকার তাদের সাহায্য করবে। কিš‘ কোন সাহায্য এখনো পর্যন্ত সে পায়নি। এভাবে সুন্দরবন এলাকায় অনেক বাঘ বিধবা হয়েছে। সুন্দরবনের হিংস্র বাঘের কবলে পড়তে তাদের স্বামীরা প্রাণ হারায়।
শেখ নাজমুল ইসলাম,শরণখোলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি,।। 





































