
প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামের একটি পুকুর পাড়ের কয়েকটি গাছে ১৮ থেকে ২০ বছর ধরে বাসা বেধেছে আসছে প্রায় ৪০- ৫০ হাজার দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। বসবাসের নিরাপদ পরিবেশ পেয়ে পুকুরপাড়ের গাছে গাছে বাসা করেছে শামুক খৈল, শামুক ভাঙ্গা, হাইতোলা মুখ নামের হাজারো পাখি। গ্রামের খাল-বিল আর ফসলের মাঠ থেকে খাবার খোঁজে খায় ওই পাখিগুলো। নিরাপদ আশ্রয়ে প্রজননও করছে তারা। এতে দিন দিন বাড়ছে পাখির সংখ্যা। এই পাখি কলোনির নিরাপত্তা দিয়ে আসছেন ওই গ্রামবাসীরা। বলছিলাম জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার কানাই পুকুর গ্রামের কথা।
রোজ পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুম ভাঙে এ গ্রামের মানুষের। গ্রামবাসী পরম যত্নে আগলে রেখেছেন পাখিগুলোকে। তাই এই গ্রাম এখন পাখির গ্রাম হিসেবে পরিচিত সাধারণ মানুষের কাছে। প্রতিদিন এসব পাখি দেখতে আসেন আশেপাশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলার মানুষ।
স্থানীয়রা বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে প্রতি বছর এই পাখিগুলো এখানে আসে এবং বাচ্চা ফুটায় এখানেই। পাখিগুলো প্রাকৃতিক সম্পদ একারণে রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তারা আরো বলেন, এই পাখিগুলো দেখতে দেশের বিভিন্ন জায়গা হতে দর্শনার্থীরা আসেন। তবে তাদের যাতায়াতের জন্য ভালো রাস্তা নেই। কানাইপুকুর গ্রামে পাখির অভয়ারণ্য গড়তে আন্তরিক হবেন স্থানীয় প্রশাসন এমন দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষেতলাল উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে আলমপুর ইউনিয়নের কানাইপুকুর গ্রামের মৃত- আব্দুস সোবাহান মন্ডলের বাড়ির পাশের পুকুর পাড়ে প্রায় ৫ বিঘা জমির উপর বট, পাইকর, নীম, তেতুল, আম, বাঁশঝাড়সহ বিভিন্ন গাছের ডালে ডালে হাজার হাজার পাখি বাসা বেধেছে। গড়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি পাখিদের অভয়াশ্রম। গাছে গাছে পাখিরা ডিম থেকে প্রজনন করছে বাচ্চাও। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে শামুকখোল, বক, কানাবক, শঙ্খচোরা, পানকৌড়ি ও হরিয়াল। তবে এর মধ্যে শামুকখোল রয়েছে সব চেয়ে বেশি। পাখির কিচিরমিচির ডাক সব সময় মুখোরিত করে রাখে গ্রামবাসীদের। তাই নিজের সন্তানের মত তারা লালন করেন এসব পাখিদের।
প্রতিদিন বিকালে হাজারও শামুকখোল পাখি এসে আশ্রয় নেয় মণ্ডলবাড়ির তেতুলতলী পুকুর পাড়ের গাছগুলোতে। কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চারপাশ। পাখিগুলো মনের সুখে ডানা ঝাপটায়, কেউবা আবার বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দেয়। প্রকৃতির অপরূপ খেয়ালে এখানে গত একযুগেরও বেশি সময় ধরে বাসা বেঁধে আসছে এসব পাখি। সন্ধ্যায় পুরো পুকুরপাড় মুখরিত হয়ে ওঠে পাখির কল-কাকলিতে। রাতভর চলে ওদের ডানা ঝাপটানো। নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে ভোর হলেই উড়ে যায়। দিনশেষে নীড়ে আবারো ফিরে আসে পাখিগুলো।
এ বিষয়ে কানাই পুকুর পাখি কলোনির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমাদের বসতবাড়ির পাশে পৈত্রিক সম্পত্তি জুরে প্রায় ১৮-২০ বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই পাখি কলোনী। প্রতি বছর পাখিগুলো এখানে আসে। ৮/৯ মাস এখানে থাকে। শীত শুরুর আগে মাঠের পানি শুকিয়ে গেলে এরা নদী এলাকার দিকে চলে যায়। আবারও গরম একটু শুরু হলে আবারও এখানে ফিরে আসে। পাখি দেখতে প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আমাদের বাড়িতে আসেন। এখানে সব চেয়ে বড় সমস্যা দর্শনার্থীদের আসার ভাল কোনো রাস্তা নেই। তাই স্থানীয় প্রশাসন যদি এখানে আসার ভাল রাস্তার ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে এটি জনপ্রিয় পাখির অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।
পাখি কলোনির সদস্য জহুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের গ্রামটি পাখির গ্রাম হিসেবে এলাকায় পরিচিত। আমাদের কলোনিতে পাখি দেখতে আসা দর্শনার্থীদের আমরা চারপাশ ঘুরে দেখাই এবং সাধ্যমতো আপ্যায়ন করার চেষ্টা করে থাকি। আমাদের বাড়িতে পাখি দেখতে যখন দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে তখন আমাদের সত্যিই খুব ভালো লাগে।
মন্ডলবাড়ির ছেলে ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ ও তামিম হোসেন জানান, পাখিগুলো যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে যায়। তখন আমরা ছুটে যাই এবং পাখিগুলোকে উদ্ধার করে নানাভাবে সেবা করার চেষ্টা করি। সেইসাথে যখন দুর থেকে কোনো দর্শনার্থী আসেন তখন তারা যাতে পাখিগুলো ভালভাবে দেখতে পায় আমরা সেই ব্যবস্থা করে দেই। প্রত্যন্ত গ্রাম হওয়ায় এখানকার রাস্তাঘাট অনেক খারাপ। রাস্তা পাকাকরণের কাজ কিছু হওয়ার পর বন্ধ হয়ে গেছে। সেজন্য দর্শনার্থীরা প্রাইভেটকার বা বড় গাড়ি নিয়ে আসতে পারে না। তারা আরো জানান, এই পাখি কলোনীকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে দোকানপাট বা বসার জায়গার ব্যবস্থা হলে দর্শনার্থীরা অনেক সুবিধা পেতো। পাশাপাশি পাখি কলোনির নামে দুইটা গেইট করলে দর্শনার্থীদের চিনতে সুবিধা হতো। কারণ অনেক সময় দর্শনার্থীরা ভূল করে অন্য গ্রামে ঢুকে পড়ে। তাই স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের ছোট অনুরোধ।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা.
পলাশ চন্দ্র জানান, জানতে পেরেছি উপজেলার কানাইপুকুর গ্রামে প্রায় ৫০ হাজার দেশি-বিদেশি পাখি বসবাস করে। আমাদের অফিসের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়াও পাখিগুলো যাতে বিলুপ্ত না হয় এবং কেউ শিকার করতে না পারে সেজন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে তদারকি করা হবে।
নিরাপত্তার সঙ্গে পাখি কলোনির দেখভাল করা হবে প্রতিশ্রুতি দিলেন স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষেতলাল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, পাখিগুলোকে যাতে কেউ শিকার করতে না পারে সে দিকটি আমরা থানা পুলিশের পক্ষ থেকে খেয়াল রাখবো।
ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি 






























