মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ৩০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই দিনে দাওয়াত পেয়ে থাকেন জামাইরা

প্রায় দেড়শ বছর ধরে প্রতি বছরই এখানে মেলা ও লাঠিখেলা হয়। সেই উপলক্ষে এই দিনে দাওয়াত পেয়ে থাকেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের দেওগ্রামে বিবাহ করা মেয়ে জামাইরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। তবে সেই হারানো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন এই গ্রামবাসী। আয়োজকরা জানান, মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৩০- ৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এ গ্রামে।
প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার দশমীর তিন দিন পর দেওগ্রামে লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বসেছে এই লাঠি খেলার মেলা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দেও গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে শতশত মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন। উদ্দেশ্য প্রতি বছর একবার লাঠি খেলা উপভোগ করা। ঢোলের বাজনা, আর কাঁসার ঘণ্টার তালে তালে লাঠির কসরত। এদিকে প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত, আবারও পাল্টা আঘাত। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন লাঠিয়ালরা। আর সেখানে উপস্থিত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষরা তাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এমনিভাবে গত দেড়শো বছর ধরে এখানে চলছে ঐতিহ্যবাহী এ লাঠি খেলা। এ উপলক্ষে এখানে মেলা বসে। লাঠি খেলা আর মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা।
দেওগ্রামে প্রবেশের জন্য প্রধান রাস্তাটির দুই ধারে এবং একটি হাফেজিয়া মাদরাসা চত্বরে বসে মূল মেলা। এছাড়া খালি পড়ে থাকা বিভিন্ন জায়গায় হরেক রকমের পণ্যের দোকান বসান দূর দূরান্ত থেকে আসা দোকানিরা। এ বছরের এ মেলার প্রধান আকর্ষণ লাঠিখেলা হলেও শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগর দোলা, চড়কি ও হরেক রকমের খেলনা, মিঠাই-মণ্ডাসহ সার্কাস ইত্যাদি।
গ্রামবাসীরা জানান, প্রায় দেড়শো বছর আগে থেকে এই লাঠি খেলার মেলা চলছে। মেলায় মেয়ের জামাই, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করা হয়। মেলার দুদিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতে শুরু করে। মেলার দিন সকালে গ্রামে গরু জবাই করা হয়। মেলার দিন দুপুরে প্রতিটি বাড়িতে ধুমধামে খাওয়া দাওয়া হয়। মেলার দিন লাঠিয়ালেরা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে লাঠি খেলা দেখান। বিকেল লোকজন মেলায় পুরোদমে কেনা-কাটা করেন। গভীর রাত পর্যন্ত মেলা চলে। তাছাড়া কাল দুপুর পর্যন্তও চলবে এই মেলা।
দেওগ্রামে বিবাহ করা জামাই তাইফুল বলেন, ১০ বছর হচ্ছে এই গ্রামে বিয়ে করেছি। সেই প্রথম থেকে এই পর্যন্ত প্রতি বছর আজকের এই দিনে শশুর বাড়িতে দাওয়াত পেয়েছি। প্রতি বছরের মতো এবারেও পরিবার নিয়ে দাওয়াত খেতে এসেছি।
মেলায় লাঠি খেলা দেখতে আসা এক যুবক বলেন, ৫ বছর ধরে এ গ্রামে লাঠিখেলা দেখতে আসি। এবার এসেছি খুব আনন্দ উপভোগ করলাম।
এক লাঠি খেলোয়াড় জানান, সেই ছোট বেলা থেকেই বাপ-দাদার লাঠি খেলা দেখে আসছি। তবে এখন আমিও দেওগ্রামসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় লাঠিখেলা দেখাই। এতে আমিও আনন্দ পাই, দর্শকদেরও আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।
দেওগ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম বলেন, মেলাকে ঘিরে জামাই-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করা হয়। মেলার দুদিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতে শুরু করেন। মেলার দিন সকালে গ্রামে গরু-ছাগল জবাই করা হয়। আজ মেলার দিন (মঙ্গলবার) সকালে দেওগ্রামে অন্তত ৭-৮টি গরু জবাই করে মাংস ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এরপরও গ্রামের অনেকেই বাজারে গিয়ে মাংস কিনে এনেছেন।
স্থানীয় মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন মন্ডল জানান, প্রায় দেড়শ বছর ধরে দেওগ্রামে লাঠিখেলা উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ মেলা উপলক্ষে গ্রামে জামাই-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনসহ অন্তত ৩০-৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
জনপ্রিয়

প্রায় দেড়শো বছর ধরে এই দিনে দাওয়াত পেয়ে থাকেন জামাইরা

প্রকাশের সময় : ০৪:৩০:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪
প্রায় দেড়শ বছর ধরে প্রতি বছরই এখানে মেলা ও লাঠিখেলা হয়। সেই উপলক্ষে এই দিনে দাওয়াত পেয়ে থাকেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের দেওগ্রামে বিবাহ করা মেয়ে জামাইরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা। তবে সেই হারানো ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন এই গ্রামবাসী। আয়োজকরা জানান, মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৩০- ৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে এ গ্রামে।
প্রতি বছর হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার দশমীর তিন দিন পর দেওগ্রামে লাঠি খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বসেছে এই লাঠি খেলার মেলা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই দেও গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির উঠানে শতশত মানুষ ভিড় জমাতে থাকেন। উদ্দেশ্য প্রতি বছর একবার লাঠি খেলা উপভোগ করা। ঢোলের বাজনা, আর কাঁসার ঘণ্টার তালে তালে লাঠির কসরত। এদিকে প্রতিপক্ষের লাঠির আঘাত, আবারও পাল্টা আঘাত। এ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন লাঠিয়ালরা। আর সেখানে উপস্থিত শিশু-কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষরা তাতে উৎসাহ দিচ্ছেন। এমনিভাবে গত দেড়শো বছর ধরে এখানে চলছে ঐতিহ্যবাহী এ লাঠি খেলা। এ উপলক্ষে এখানে মেলা বসে। লাঠি খেলা আর মেলাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠেন গ্রামবাসীরা।
দেওগ্রামে প্রবেশের জন্য প্রধান রাস্তাটির দুই ধারে এবং একটি হাফেজিয়া মাদরাসা চত্বরে বসে মূল মেলা। এছাড়া খালি পড়ে থাকা বিভিন্ন জায়গায় হরেক রকমের পণ্যের দোকান বসান দূর দূরান্ত থেকে আসা দোকানিরা। এ বছরের এ মেলার প্রধান আকর্ষণ লাঠিখেলা হলেও শিশু-কিশোরদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগর দোলা, চড়কি ও হরেক রকমের খেলনা, মিঠাই-মণ্ডাসহ সার্কাস ইত্যাদি।
গ্রামবাসীরা জানান, প্রায় দেড়শো বছর আগে থেকে এই লাঠি খেলার মেলা চলছে। মেলায় মেয়ের জামাই, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করা হয়। মেলার দুদিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতে শুরু করে। মেলার দিন সকালে গ্রামে গরু জবাই করা হয়। মেলার দিন দুপুরে প্রতিটি বাড়িতে ধুমধামে খাওয়া দাওয়া হয়। মেলার দিন লাঠিয়ালেরা পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে লাঠি খেলা দেখান। বিকেল লোকজন মেলায় পুরোদমে কেনা-কাটা করেন। গভীর রাত পর্যন্ত মেলা চলে। তাছাড়া কাল দুপুর পর্যন্তও চলবে এই মেলা।
দেওগ্রামে বিবাহ করা জামাই তাইফুল বলেন, ১০ বছর হচ্ছে এই গ্রামে বিয়ে করেছি। সেই প্রথম থেকে এই পর্যন্ত প্রতি বছর আজকের এই দিনে শশুর বাড়িতে দাওয়াত পেয়েছি। প্রতি বছরের মতো এবারেও পরিবার নিয়ে দাওয়াত খেতে এসেছি।
মেলায় লাঠি খেলা দেখতে আসা এক যুবক বলেন, ৫ বছর ধরে এ গ্রামে লাঠিখেলা দেখতে আসি। এবার এসেছি খুব আনন্দ উপভোগ করলাম।
এক লাঠি খেলোয়াড় জানান, সেই ছোট বেলা থেকেই বাপ-দাদার লাঠি খেলা দেখে আসছি। তবে এখন আমিও দেওগ্রামসহ বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় লাঠিখেলা দেখাই। এতে আমিও আনন্দ পাই, দর্শকদেরও আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করি।
দেওগ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম বলেন, মেলাকে ঘিরে জামাই-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত করা হয়। মেলার দুদিন আগে থেকে আত্মীয়-স্বজনরা গ্রামে আসতে শুরু করেন। মেলার দিন সকালে গ্রামে গরু-ছাগল জবাই করা হয়। আজ মেলার দিন (মঙ্গলবার) সকালে দেওগ্রামে অন্তত ৭-৮টি গরু জবাই করে মাংস ভাগ বাটোয়ারা করে নেওয়া হয়েছে। এরপরও গ্রামের অনেকেই বাজারে গিয়ে মাংস কিনে এনেছেন।
স্থানীয় মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন মন্ডল জানান, প্রায় দেড়শ বছর ধরে দেওগ্রামে লাঠিখেলা উপলক্ষে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ মেলা উপলক্ষে গ্রামে জামাই-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনসহ অন্তত ৩০-৪০ হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।