সোমবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কেমন গেল অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন

ছবি-সংগৃহীত

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরচার আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতা। শেখ হাসিনার পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট শপথ নেন অর্ন্তবর্তী সরকার। যার প্রধান হিসেবে রয়েছেন দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার আজ ১০০তম দিন পার করছে।

দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। শুরু থেকে অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, আওয়ামী লীগের বহুমুখী ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু, রাজনৈতিক দলগুলোর নানা দাবি, বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বহুমুখী দাবিতে বারবার অস্থিরতার তৈরি হওয়ায় চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে।

এসব আন্দোলন দক্ষতার সঙ্গে সামালও দিয়েছে সরকার। কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখা দিলেও সফলতার হারই বেশি।

এরমধ্যে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকাজ শুরু, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও আটটি জাতীয় দিবস বাদ দেওয়া, অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ, বিভিন্ন ক্ষেত্র সংস্কারে কমিশন গঠনসহ নানা উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা উদ্দীপনা, প্রত্যাশায় নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে এদেশের মানুষ।

তবে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রোডম্যাপ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।

সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনমুখী সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। সাধারণ মানুষ ইউনূস সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেও নির্বাচনমুখী হতে চাপ সৃষ্টি করছে বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্যসহ রাজনৈতিক দলগুলো।

সরকারের যত সফলতা

১০ কমিশন গঠন

আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে মন্ত্রণালয়, বিচারব্যবস্থা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙে পড়ে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। তবে দায়িত্ব নিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে ১০টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। এরমধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এছাড়া গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কমিশন গঠন করা হয়েছ। এসব সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কার করবে সরকার।

ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যুনাল

এ সরকারের আরেকটি গুরুত্বকপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিচারকাজ শুরু করেছে ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র‍্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে দুই বার জবানবন্দী দিয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ

নির্বাচন, সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দুই দফায় সংলাপে বসেছে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টারা। রাজনৈতিক নেতারাও তোলে ধরেন বিভিন্ন প্রস্তাবনা। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়াও নির্বাচনের বিষয়ে আজারবাইজানে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে সরকার।

অভ্যুত্থানে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার সিদ্ধান্ত

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের আমৃত্যু চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরমধ্যে আহতরা পাবেন ইউনিক আইডি কার্ড। যেটির মাধ্যমে দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল ও সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে তারা। এছাড়া পুর্নবাসন, চাকরির ব্যবস্থা করবে। টেলি মেডিসিনের আওতায় আহতরা পাবেন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা।

জাতীয় আট দিবস বাতিল

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।

ব্যক্তির নামের মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন

আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদর নামে প্রতিষ্ঠিত ৬টি মেডিকেল কলেজের নাম পরির্বতন করেছে সরকার। এরমধ্যে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, মানিকগঞ্জ–এর পরিবর্তে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ। আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী–এর পরিবর্তে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর–এর পরিবর্তে জামালপুর মেডিকেল কলেজ। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল–এর পরিবর্তে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর–এর পরিবর্তে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ। এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর–এর পরিবর্তে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

সন্ত্রাসী দমনে অভিযান

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক ও সন্ত্রাস দমনে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে সরকার। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি মাদক নির্মূলে কাজ করছে আইনশঙ্খলা বাহিনী।

আরও গুরুত্বপূর্ণ সেসব সিদ্ধান্ত

দায়িত্ব পেয়ে অভ্যুত্থানে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের দিকে সুনজর দেন সরকার। এরমধ্যে গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ, শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’গঠন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের দখলে নেওয়া ব্যাংকগুলোকে দখল মুক্ত করে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু। ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা। গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে- এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত।

এছাড়া গত ১৬ বছরে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তি ও পরিবারকে সুরক্ষা দিতে গঠন করা হয়েছে কমিশন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো ও দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

গত ১০০ দিনে নানামুখী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কয়েকটি সিদ্ধান্তে সরকারকে পড়তে হয়েছে সমালোচনায়। এরমধ্যে অন্যতম হলো উপদেষ্টা পরিষদে বিতর্কিতদের নিয়োগ, নির্বাচনর সঠিক রোডম্যাপ প্রণয়ন না করা, দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারা অন্যতম।

উপদেষ্টা পরিষদে বিতর্কিত ব্যক্তি

গত ৮ আগস্ট ১৬ সদস্য নিয়ে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরবর্তীতে দুই দফায় আরও ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া দুই উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী নিয়ে সমালোচনায় পড়তে হয়েছে সরকারকে। শপথ নেয়ার সময়েই বঙ্গভবনের সামনে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন ছাত্র-জনতা। এছাড়াও এই উপদেষ্টার নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন।

নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বকালের সঠিক সময় নির্ধারণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন, আলোচনা সভাও করে যাচ্ছে এসব দল। কবে নাগাদ নির্বাচন দিবেন সেটি পরিষ্কার করার দাবি তাদের। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোন রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ছিল তীব্রভাবে। তবে ড. ইউনূসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। লাঘামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম। তবে সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।

সূত্র-দ্য নিউজ

জনপ্রিয়

বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়া ও মিল্টনের ‎মনোনয়ন জমা 

কেমন গেল অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন

প্রকাশের সময় : ০৫:৫৬:৪৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় স্বৈরচার আওয়ামী লীগ সরকারের। দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ অনেক নেতা। শেখ হাসিনার পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট শপথ নেন অর্ন্তবর্তী সরকার। যার প্রধান হিসেবে রয়েছেন দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার আজ ১০০তম দিন পার করছে।

দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে সরকারকে। শুরু থেকে অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, আওয়ামী লীগের বহুমুখী ষড়যন্ত্র, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু, রাজনৈতিক দলগুলোর নানা দাবি, বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বহুমুখী দাবিতে বারবার অস্থিরতার তৈরি হওয়ায় চ্যালেঞ্জে পড়তে হয়েছে।

এসব আন্দোলন দক্ষতার সঙ্গে সামালও দিয়েছে সরকার। কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা দেখা দিলেও সফলতার হারই বেশি।

এরমধ্যে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারকাজ শুরু, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও আটটি জাতীয় দিবস বাদ দেওয়া, অভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ, বিভিন্ন ক্ষেত্র সংস্কারে কমিশন গঠনসহ নানা উদ্যোগ ছিল চোখে পড়ার মতো।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা উদ্দীপনা, প্রত্যাশায় নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে এদেশের মানুষ।

তবে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে রোডম্যাপ নিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো।

সংস্কারের চেয়ে নির্বাচনমুখী সংস্কারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। সাধারণ মানুষ ইউনূস সরকারকে সময় দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিলেও নির্বাচনমুখী হতে চাপ সৃষ্টি করছে বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্যসহ রাজনৈতিক দলগুলো।

সরকারের যত সফলতা

১০ কমিশন গঠন

আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে মন্ত্রণালয়, বিচারব্যবস্থা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভেঙে পড়ে। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয় প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। তবে দায়িত্ব নিয়েই এসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে ১০টি কমিশন গঠন করেছে সরকার। এরমধ্যে রয়েছে, সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন। এছাড়া গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির কমিশন গঠন করা হয়েছ। এসব সংস্কার কমিশন ইতিমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কার করবে সরকার।

ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার বিচারে ট্রাইব্যুনাল

এ সরকারের আরেকটি গুরুত্বকপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণহত্যার মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বিচারকাজ শুরু করেছে ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, সাবেক মন্ত্রী-ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হকসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের নেতা, পুলিশের তৎকালীন আইজিসহ বেশ কয়েকজন সদস্য, র‍্যাবের তৎকালীন ডিজি, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাদের আসামি করা হয়। সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ট্রাইব্যুনালে দুই বার জবানবন্দী দিয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ

নির্বাচন, সংস্কারের বিষয়ে বিএনপি, জামায়াত ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দুই দফায় সংলাপে বসেছে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টারা। রাজনৈতিক নেতারাও তোলে ধরেন বিভিন্ন প্রস্তাবনা। এছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়াও নির্বাচনের বিষয়ে আজারবাইজানে কথা বলেছেন ড. ইউনূস। সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে সরকার।

অভ্যুত্থানে আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবার সিদ্ধান্ত

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে আহতদের আমৃত্যু চিকিৎসা সেবা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরমধ্যে আহতরা পাবেন ইউনিক আইডি কার্ড। যেটির মাধ্যমে দেশের সকল সরকারি হাসপাতাল ও সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা পাবে তারা। এছাড়া পুর্নবাসন, চাকরির ব্যবস্থা করবে। টেলি মেডিসিনের আওতায় আহতরা পাবেন মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসা।

জাতীয় আট দিবস বাতিল

অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস বলে পরিচিত আটটি জাতীয় দিবস বাদ দিয়েছে। দিবসগুলো হলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, ১৭ মার্চ জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস, ৫ আগস্ট শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামালের জন্মবার্ষিকী, ৮ আগস্ট বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মবার্ষিকী, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেল দিবস, ৪ নভেম্বর জাতীয় সংবিধান দিবস ও ১২ ডিসেম্বর স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস।

ব্যক্তির নামের মেডিকেল কলেজের নাম পরিবর্তন

আওয়ামী লীগের সরকারের আমলে শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগ নেতাদর নামে প্রতিষ্ঠিত ৬টি মেডিকেল কলেজের নাম পরির্বতন করেছে সরকার। এরমধ্যে কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ, মানিকগঞ্জ–এর পরিবর্তে মানিকগঞ্জ মেডিকেল কলেজ। আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ, নোয়াখালী–এর পরিবর্তে নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, জামালপুর–এর পরিবর্তে জামালপুর মেডিকেল কলেজ। শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ, টাঙ্গাইল–এর পরিবর্তে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ, ফরিদপুর–এর পরিবর্তে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ। এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ, দিনাজপুর–এর পরিবর্তে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।

সন্ত্রাসী দমনে অভিযান

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক ও সন্ত্রাস দমনে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে সরকার। রাজধানীর মোহাম্মদপুর, জেনেভা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকায় যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি মাদক নির্মূলে কাজ করছে আইনশঙ্খলা বাহিনী।

আরও গুরুত্বপূর্ণ সেসব সিদ্ধান্ত

দায়িত্ব পেয়ে অভ্যুত্থানে গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের দিকে সুনজর দেন সরকার। এরমধ্যে গণহত্যার বিচারে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরকে আমন্ত্রণ, শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি, আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা এবং শহীদদের পরিবারের দেখাশোনার জন্য ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’গঠন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা ও ব্যবসায়ীদের দখলে নেওয়া ব্যাংকগুলোকে দখল মুক্ত করে নতুন পরিচালনা পরিষদ গঠন করেছে। দুর্নীতি ও অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রভাবশালী দেড়শ ব্যক্তির তালিকা তৈরি ও ৭৯ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু। ১৫ শতাংশ হারে আয়কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত পরিসম্পদ অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল; দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন চলমান সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা। গণশুনানি ছাড়া নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি না করার সিদ্ধান্ত। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্প কিংবা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) যাওয়ার প্রক্রিয়াধীন আছে- এমন প্রকল্প পুনরায় যাচাই-বাছাই করার সিদ্ধান্ত।

এছাড়া গত ১৬ বছরে বলপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তি ও পরিবারকে সুরক্ষা দিতে গঠন করা হয়েছে কমিশন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (সংশোধিত ২০২১)-এর অধীন সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনা জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন; মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহত হওয়ার ঘটনায় ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানানো ও দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তিসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদীর পানিবণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

গত ১০০ দিনে নানামুখী গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের পাশাপাশি কয়েকটি সিদ্ধান্তে সরকারকে পড়তে হয়েছে সমালোচনায়। এরমধ্যে অন্যতম হলো উপদেষ্টা পরিষদে বিতর্কিতদের নিয়োগ, নির্বাচনর সঠিক রোডম্যাপ প্রণয়ন না করা, দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারা অন্যতম।

উপদেষ্টা পরিষদে বিতর্কিত ব্যক্তি

গত ৮ আগস্ট ১৬ সদস্য নিয়ে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পরবর্তীতে দুই দফায় আরও ১০ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ নিয়োগ পাওয়া দুই উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী নিয়ে সমালোচনায় পড়তে হয়েছে সরকারকে। শপথ নেয়ার সময়েই বঙ্গভবনের সামনে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন ছাত্র-জনতা। এছাড়াও এই উপদেষ্টার নিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন সংগঠন।

নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি

অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বকালের সঠিক সময় নির্ধারণ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলন, আলোচনা সভাও করে যাচ্ছে এসব দল। কবে নাগাদ নির্বাচন দিবেন সেটি পরিষ্কার করার দাবি তাদের। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও কোন রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়নি।

দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি ছিল তীব্রভাবে। তবে ড. ইউনূসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। লাঘামহীনভাবে বেড়েছে দ্রব্যমূল্যের দাম। তবে সরকার দ্রুত সময়ের মধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।

সূত্র-দ্য নিউজ