
আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের প্রভাবে দেশীয় বাজারেও কমছে ডলারের দাম। সেই সঙ্গে বাড়ছে টাকার মান। ব্যাংকে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডলারের দর কমেছে প্রায় ৩ টাকা।
সোমবার (১৪ জুলাই) ডলারের সর্বোচ্চ দাম ছিল ১২০ টাকা। মূলত চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় ডলারের এই নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
যদিও ডলারের দাম কমার প্রভাব দেখা যায়নি খোলাবাজারে। সেখানে আগের দামেই ডলার কেনাবেচা করতে দেখা গেছে। ডলারের দাম কমায় আমদানিতে স্বস্তি থাকলেও রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সে আশঙ্কা রয়েছে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে প্রথমবারের মতো নিলামে ১৭ কোটি ডলার কিনেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গত তিন বছর ধরে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডলারের উচ্চ দাম। তাদের মতে, এখন ডলারের দাম কমলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। অন্তর্বর্তী সরকারেরও অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। যদিও ডলারের দরকে পড়তে না দিয়ে ধরে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলে তারা বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে অন্যতম লক্ষ্য বললেও কেন বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দর ধরে রাখতে চাইছে তা বোধগম্য নয়।
এই প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত তিন বছরের মূল্যস্ফীতির বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডলারের দাম বৃদ্ধিই ছিল মূল চালক। এমনকি আইএমএফের রিপোর্টেও বলা হয়েছিল, ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতির অন্তত ৫০ শতাংশ ডলারের দাম বৃদ্ধিজনিত। এই প্রেক্ষাপটে ডলারের দাম কমা স্বাগত হওয়ার কথা।
এতে আমদানি খরচ কমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করার সুযোগ এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম কমতে না দিয়ে তা ধরে রাখার চেষ্টা করছে। নিলামে বাজার থেকে ডলার কিনছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি প্রশ্ন তোলে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি কমানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ডলারের দামকে কমতে দিচ্ছে না কেন? যেখানে ৮৫ টাকা থেকে ১২২ টাকায় ডলারের দাম গিয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সেই একই হাতিয়ার এখন ব্যবহার করছে না কেন?’
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্স আর রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি দর কমে। কিন্তু হুন্ডির বাজারে এখন তেমন লাভজনক দাম নেই বলেই প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছেন। সুতরাং এখানেও ঝুঁকি অতটা বড় নয় বলে মন্তব্য করে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার মতে, রপ্তানি সক্ষমতার কথা বলে যেটুকু দুশ্চিন্তা করা হচ্ছে, তা অতিরিক্ত। কারণ আন্তর্জাতিকভাবেই ডলারের দর কমছে- সুতরাং সবাই কিছুটা সক্ষমতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশও তুলনামূলকভাবে খুব একটা পিছিয়ে পড়বে না।’
একই বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, ‘মুদ্রার বিনিময় হার যেন হুট করে ওঠানামা না করে, সেই বিষয়টিই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হলো সবদিক ঠিক রাখা। রপ্তানি, রেমিট্যান্স, মূল্যস্ফীতিসহ আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ঠিক রাখাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। এখন যদি ডলারের দাম হঠাৎ কমিয়ে দিই, রেমিট্যান্স আসা কমে যেতে পারে। আবার রপ্তানিকারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বর্তমানে বাজারভিত্তিক প্রক্রিয়ায় চলছি। ডলারের দর ধরে রাখছি- এটা ঠিক নয়। বরং দামের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে চাই।’
বাজার থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিলামে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত রবিবার ১৮টি ব্যাংকের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ১২০ টাকা ৩০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ১২১ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত দরে এই ডলার কিনেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। আবার ডলারের চাহিদাও কমেছে। ফলে ডলারের দাম টাকার তুলনায় এক সপ্তাহ ধরে কমছে। এই পরিস্থিতিতে ডলারের দাম ধরে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসাইন খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ডলারের দাম কমলে আমদানিতে স্বস্তি এলেও রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে জন্যই টাকার বিপরীতে ডলারের দাম স্থির রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে।’ তিনি বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার টাকার তুলনায় বেড়ে গেলে একইভাবে নিলামের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’
চাহিদা নেই বলেই ডলারের দাম কমছে
বর্তমানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ফলে আমদানিতে গতি নেই। এলসি খোলার হারও প্রতিনিয়ত কমছে। ব্যাংকগুলোর ডলার চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। অনেক ব্যাংক এখন ডলার ধরে রাখতে না চেয়ে বরং বিক্রি করে দিতে চাইছে। আমদানি এলসি কমে যাওয়া এবং রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ফলে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে বলেই মনে করছেন ব্যাংকাররা।
তাদের মতে, এক সময় বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো থেকে ডলার কেনার জন্য ব্যাংকগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ত। এখন উল্টো চিত্র। ডলার সরবরাহ বাড়ায় অনেক ব্যাংকই আগ্রহ হারাচ্ছে বেশি দামে কিনতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘‘বর্তমান পরিস্থিতিতে ডলারের দরপতন একদিক দিয়ে ভালো। আমদানিকারকদের জন্য এটা সুবিধাজনক- কম দামে পণ্য আনতে পারছে। আর এটা হঠাৎ হয়নি, আমরা গত কয়েক মাস ধরে কিছু ট্রেন্ড দেখছি। একদিকে রেমিট্যান্স বেড়েছে, অন্যদিকে আমদানি কিছুটা কমেছে- বিশেষ করে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপক কমেছে।
ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট ইতিবাচক রয়েছে। ‘ওভার ইনভয়েসিং’ বা অর্থ বিদেশে পাচারের প্রবণতা অনেকটা কমে এসেছে। আগে এই কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে চাপ তৈরি হতো। এখন সেই চাপ নেই, যা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। রপ্তানিকারকরা কিছুটা কম রিটার্ন পেতে পারেন, বিশেষ করে যারা সর্বোচ্চ রেট পেতেন, তবে সামগ্রিকভাবে আমদানির খরচ কমে যাওয়ায় অর্থনীতির ওপর চাপ হালকা হয়েছে। ডলারের দর হ্রাস এখন পর্যন্ত একটি স্বস্তিদায়ক ইঙ্গিত দিচ্ছে- বিশেষ করে আমদানিনির্ভর খাতগুলোর জন্য। তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা জরুরি। সূত্র-খবরের কাগজ
বার্তাকণ্ঠ ডেস্ক 




























