
ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি:
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়ন পরিষদের ভিডাব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) সুবিধাভোগীর তালিকায় ইউপি সদস্যের স্বজন ও স্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের নাম উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি সহায়তার আওতায় এই স্বচ্ছল নারীরা প্রতি মাসে বিনামূল্যে ৩০ কেজি করে চাল পাচ্ছেন, অথচ প্রকৃত দরিদ্র নারীরা বঞ্চিত হয়েছেন।
বড়তারা গ্রামের স্বপ্না খাতুনের রয়েছে ইটের পাকা বাড়ি, স্বামী ইজিবাইক চালক এবং গোয়ালে লাখ টাকারও বেশি মূল্যের গরু। সংসারে অভাব না থাকলেও তিনি ভিডাব্লিউবির সুবিধাভোগীর তালিকায় নাম উঠিয়েছেন এবং প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল নিচ্ছেন। অথচ তাঁর বাড়ির সামনের পাঁচ হাত দূরেই হালিমা খাতুন নামের এক দরিদ্র নারী ভাঙাচোরা মাটির ঘরে বসবাস করেন। তাঁর স্বামী জাহিদুল ইসলাম দিনমজুর। সহায়-সম্পদ বলতে কিছুই নেই, কিন্তু তিনি এই কর্মসূচির আওতায় আসেননি। স্বপ্না খাতুন নিজেও স্বীকার করেছেন, হালিমা খাতুনের চেয়ে তাঁদের আর্থিক অবস্থা অনেক ভালো। শুধু তিনি নন, এভাবেই বড়তারা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বহু স্বচ্ছল পরিবার ও ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের আত্মীয়-স্বজনদের নাম সুবিধাভোগীর তালিকায় উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে— ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান ঘুষ ও আত্মীয়তাকে প্রাধান্য দিয়ে তালিকা করেছেন।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় ও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বড়তারা ইউনিয়নে ভিডাব্লিউবি কর্মসূচির আওতায় মোট ১,০২৭ জন নারী আবেদন করেছিলেন। উপজেলা প্রশাসন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য তিনজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়। তাঁরা ইউনিয়ন পরিষদে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই শেষে ৪৪০ জন সুবিধাভোগী নির্বাচন করেন। ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত হন ৫৩ জন নারী। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তাঁদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হয়। এরপর স্বচ্ছল পরিবারের নাম তালিকায় উঠে আসায় বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, সুবিধাভোগীর তালিকার ১৯১ নম্বরে রাজিয়া সুলতানা, ২০৬ নম্বরে হাবিবা খাতুন, ২০৯ নম্বরে স্বপ্না খাতুন, ২১০ নম্বরে খোতেজা বিবি, ২১৬ নম্বরে আলেয়া বেগম, ২১৭ নম্বরে আমেনা বিবি, ২২৪ নম্বরে মোছা. ফারহানা আক্তার এবং ২৩০ নম্বরে মোছা. সেলিনা বেগমের নাম রয়েছে।
তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের আত্মীয়: রাজিয়া সুলতানা শফিকুল ইসলামের চাচাতো ভাই মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী। হাবিবা খাতুন ফ্ল্যাটবাড়ির মালিক, তাঁর স্বামী রায়হান কবির মৎস্যচাষী, নিজস্ব জমিজমা ও মোটরসাইকেলসহ ভুটভুটি রয়েছে। স্বপ্না খাতুন ইজিবাইকচালক স্বামীর স্ত্রী, পাকা বাড়ি ও গরু রয়েছে। খোতেজা বিবির স্বামী হেলালের ইলেকট্রনিক্স দোকান ও অটোভ্যান ব্যবসা রয়েছে।
আমেনা বেগম সাত বিঘা জমির মালিক, ইউপি সদস্যের আপন চাচি। সেলিনা বেগম ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের ভাইয়ের স্ত্রী, পাকা বাড়ি আছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ— ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম তাঁর আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠদের নাম তালিকায় দিয়েছেন এবং যারা টাকা দিয়েছেন তাদেরও নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এতে প্রকৃত গরিব নারীরা বাদ পড়েছেন।
বড়তারা গ্রামের হালিমা খাতুন বলেন, বড়লোকেরা ৩০ কেজি চাউলের কার্ড পায়, মোর কিছু নাই, মোক কার্ড দ্যাইনি। লাইনত দাঁড়াচুনু, মোক বাদ দিচে।
অন্য এক নারী সকিমা বিবি বলেন, আমরা গরিব মানুষ, টাকাও নাই, কার্ডও নাই।
অভিযোগের বিষয়ে ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় যাচাই-বাছাই করে তালিকা করেছে। এখানে আমার কোনো হাত নেই। আত্মীয়-স্বজনেরা যদি পাওয়ার যোগ্য হয়, তাহলে পাবে না কেন?
ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, তালিকা তৈরি করেছেন উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আমরা শুধু সহযোগিতা করেছি। তবে কিছু স্বচ্ছল নারীর নাম তালিকায় এসেছে, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয় বিষয়টি তদন্ত করছে।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা লায়লা নাসরিন জাহান বলেন, ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আমরা বিষয়টির সত্যতা পেয়েছি এবং তদন্ত চলছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুরো ইউনিয়নে ভিডাব্লিউবি সুবিধাভোগী নির্বাচনে টাকার বিনিময়ে নাম তোলা হয়েছে। অথচ উপজেলা প্রশাসন ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাইয়ের ঘোষণা দিয়েছিল, যা এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
ক্ষেতলাল (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: 



















