
রুকন উদ্দিন (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি:
নেত্রকোণার কেন্দুয়ায় নবনির্মিত “জালাল মঞ্চ” ইতিহাসের সাক্ষী। তবে “জালাল মঞ্চ” নির্মাণের খাত ও ব্যয়ের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় গতকাল মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর) রাতে “জালাল মঞ্চ” নির্মাণের খাত ও ব্যয়ের তথ্য সম্বলিত একটি প্রেসনোট প্রকাশ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কেন্দুয়া পৌর প্রশাসক ইমদাদুল হক তালুকদার।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের সাক্ষরিত প্রেসনোটের মাধ্যমে জানা যায়, মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত মরমী বাউল কবি জালাল উদ্দীন খাঁ-কে স্মরণ ও কেন্দুয়া উপজেলাকে “লোকজ সংস্কৃতির রাজধানী” হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে “জালাল মঞ্চ”। চলতি মাসের গত ১৪ অক্টোবর নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামান নবনির্মিত “জালাল মঞ্চ” এর শুভ উদ্বোধন করেন। সাংবাদিকগণ অনুসন্ধানে জানতে পারেন মঞ্চ নির্মাণে পৌরসভাও অর্থ ব্যয় করেছেন কিন্তু নাম ফলকে শুধু উপজেলা প্রশাসন লেখা তার ব্যখ্যা দিয়ে প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয় একইদিনে একাধিক ফলক স্থাপনে ভুলবশত মঞ্চের ফলক বাস্তবায়নকারী শুধুমাত্র উপজেলা প্রশাসনের নাম উল্লেখ করা হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নাম হবে “কেন্দুয়া পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসন” ভুলের বিষয়টি নজরে আসলে সংশোধিত নাম দিয়ে ফলক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানা গেছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে উপজেলা পরিষদের সাধারণ সভায় লেডিস ক্লাব সংলগ্ন মাঠে একটি মুক্ত মঞ্চ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পৌরসভা ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ অর্থায়নে নবনির্মিত এই মঞ্চে প্রথম ধাপে পৌরসভা থেকে ৭ লাখ ৯ হাজার ২’শ ৫৩ টাকা ৫১ পয়সা, দ্বিতীয় ধাপে ৯ লাখ ৯৮ হাজার ৫’শ ১০ টাকা ব্যয় হয়। মঞ্চের আশপাশের মাঠ ও নিচু স্থানে মাটি ভরাটের জন্য উপজেলা পরিষদের টিআর প্রকল্প থেকে ২ লাখ ব্যয় করা হয়েছে এবং বেদী বর্ধিতকরণ ও প্লাস্টারকাজে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা উপজেলা পরিষদ বহন করিবে যা বকেয়া রয়েছে।
“জালাল মঞ্চ” এর নকশা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ও আরসিসি কাঠামোতে নির্মিত। চারুশিল্পী রবিউল ইসলাম রুদ্রের তত্ত্বাবধানেে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ৮ জন শিল্পী পেছনের দেয়ালে মুরাল ও ম্যুরাল টাইলসের কাজ করেছেন, এতে কেন্দুয়া’র লোকজ সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে।
উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, মঞ্চটি নাটক, নাচসহ সাংস্কৃতিক আয়োজনের উপযোগী করে সামনে আরও দুই ফুট সম্প্রসারণ করা হবে। পাশাপাশি মঞ্চপ্রাঙ্গণে পার্কিং টাইলস, আলোকসজ্জা, বেষ্টনী ও “লোক-সংস্কৃতির রাজধানী কেন্দুয়া” শিরোনামের স্থায়ী ফলক স্থাপনের পরিকল্পনাও রয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কেন্দুয়াকে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা।
কেন্দুয়া’র সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষায় সকল শ্রেণি-পেশা মানুষের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, কেন্দুয়া’র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্য “জালাল মঞ্চ” নির্মাণের খাত এবং ব্যয়ের হিসাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রয়াত মরমী বাউল সাধক গীতিকবি জালাল উদ্দীন খাঁ ১৮৯৪ খ্রীস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া ইউনিয়নের আসদহাটি (সিংহেরগাঁও) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সদরুদ্দীন খাঁ।
বাউল সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ ছোটবেলা থেকেই খুব প্রতিভাবান ছিলেন। তিনি তাঁর সাধনায় সক্রিয় হয়ে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব ও মালজোড়া সহ অসংখ্য গান রচনা করেছিলেন। এই গুণীর জীবদ্দশায় চার খন্ডের “জালাল গীতিকা” গ্রন্থে ৬’শ ৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল এবং মৃত্যুর পর পঞ্চম খন্ডের ৭২ টি গান সহ মোট ৭’শ ২টি গান সম্বলিত ‘জালাল গীতিকা সমগ্র’ নামে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়।
জালাল উদ্দীন খাঁ ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই স্ত্রী, দুই পুত্র, তিন কন্যা, অসংখ্য গুণগ্রাহী, আত্মীয়-স্বজন, অনুসারী এবং ভক্তবৃন্দদের কাঁদিয়ে তাঁর লেখার সৃষ্টি ভবিষ্যত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের জন্য রেখে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ির আঙিনায় মাজার অবস্থিত রয়েছে। এখনো অগুনিত শিল্পী, পাঠক, স্রোতা ভক্তবৃন্দ তাঁর সৃষ্টিকে বিভিন্নভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
মরমী বাউল সাধক জালাল উদ্দীন খাঁ শিল্পকলায় (সংগীত) অসামান্য অবদান রাখায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গত ২০২৪ সালে “একুশে মরণোত্তর পদক” তাঁর পরিবারের হাতে তুলে দেন।
যোগদান করার পরপরই উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভার উদ্যোগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদারের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ এপ্রিল কেন্দুয়া জয়হরি স্প্রাই সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে জাঁকজমকপূর্ণভাবে “জালাল মেলা” অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশ বরেণ্য জালাল ভক্ত বাউল শিল্পী সহ দেশের খ্যাতনামা ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
রুকন উদ্দিন (নেত্রকোণা) প্রতিনিধি: 







































