
মারুফ বাবু, মোংলা প্রতিনিধিঃ
দেশের নদী ও মোহনায় একসময় এমন এক কচ্ছপ সাঁতার কাটত, যা দেখতে পেলেই বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যেত। প্রায় ২৫ থেকে ২৭ কেজি ওজনের বিশাল আকৃতির কচ্ছপটির নাম বাটাগুর বাসকা। স্থানীয়ভাবে একে “নদীর কাইট্টা কচ্ছপ” নামেও ডাকা হতো। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন কচ্ছপের তালিকায় শীর্ষে থাকা এই প্রজাতি একসময় বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল।
একসময় সুন্দরবন থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মোহনা ও নদীগুলোতে এদের বিচরণ ছিল। কিন্তু আজ তাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে হাতে গোনা কয়েক ডজন প্রজননক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক কচ্ছপের ওপর। দীর্ঘদিন পর বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক গবেষকদের প্রচেষ্টায় আবারও জীবনের আলো দেখতে শুরু করেছে এক সময়ের নদীর এই দৈত্যকচ্ছপটি।
বাটাগুর বাসকা পরিবারভুক্ত বড় আকৃতির এক প্রজাতির কচ্ছপ। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ কচ্ছপের খোলস অপেক্ষাকৃত গাঢ়, আর প্রজনন ঋতুতে মাথা ও গলায় উজ্জ্বল হলুদ, লাল ও কালো রঙের দাগ দেখা যায়। যা স্ত্রী কচ্ছপের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এছাড়া একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ কচ্ছপের ওজন হয় ১২ থেকে ১৪ কেজি পর্যন্ত আর স্ত্রী কচ্ছপের ওজন হয় ২৫ থেকে ২৭ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা সাধারণত নদীর মোহনা, মিঠা পানি, লোনা পানির খাল ও জোয়ারভাটার অঞ্চলে বসবাস করে। স্ত্রী কচ্ছপ বালুময় নদীতটে গর্ত খুঁড়ে ডিম পাড়ে, এবং প্রতি প্রজনন মৌসুমে ২০ থেকে ৩৪টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে।
বাটাগুর বাসকা সর্বভুক প্রকৃতির। এরা জলজ উদ্ভিদ, শৈবাল, ফল, শামুক ও ছোট ক্রাস্টাশিয়ান খেয়ে থাকে। নদী ও মোহনার জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় এই প্রজাতির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের খাদ্যাভ্যাস জলজ উদ্ভিদের অতিবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে পানির মান উন্নত রাখে। তাই এদেরকে নদী ও উপকূলীয় বাস্তুতন্ত্রের ‘প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ বলা হয়।
একসময় সুন্দরবন থেকে শুরু করে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়া উপকূল পর্যন্ত এই কচ্ছপের বসতি ছিল। তবে নির্বিচারে শিকার, নদীতটে মানুষের দখল, বাসস্থান ধ্বংস, মাছ ধরার জাল ও দূষণের কারণে বাটাগুর বাসকার সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে যায়। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা এই প্রজাতিকে মহাবিপন্ন তালিকাভুক্ত করেছে। একসময় পদ্মা, মেঘনা, পায়রা ও সুন্দরবনের নদীগুলোতে নিয়মিত দেখা যেত এই কচ্ছপ। কিন্তু ২০০০ সালের দিকে গবেষকেরা ধারণা করেন, পৃথিবীতে আর বাটাগুর বাসকার কোনো অস্তিত্ব নেই।
২০০৮ সালে কিছু প্রাণীবিজ্ঞানী এই প্রজাতির খোঁজে নেমে পড়েন। সেই অভিযানে নোয়াখালী ও বরিশালের জলাশয়ে আটটি বাটাগুর বাসকা পাওয়া যায়। যার চারটি পুরুষ ও চারটি স্ত্রী। বন বিভাগ তখন সেগুলোকে উদ্ধার করে প্রজননের উদ্দেশ্যে গাজীপুরের ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানে নিয়ে যায়। সেখানকার কর্মকর্তারা কচ্ছপগুলোকে নিবিড়ভাবে লালন-পালন ও প্রজননের চেষ্টা শুরু করেন। শুরুতে সাফল্য সীমিত হলেও, ২০১৪ সালের মধ্যে গাজীপুর কেন্দ্রে প্রায় ৯৪টি ছানা জন্ম নেয়। এরপর প্রজনন কার্যক্রম আরও জোরদার করার জন্য আটটি কচ্ছপ ও তাদের জন্ম দেওয়া ছানাগুলোকে সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়।
করমজল বন্যপ্রাণী প্রজননকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির জানান, এখন পর্যন্ত করমজলে ৫১৯টি ডিম থেকে ৪৩৩টি বাচ্চা ফুটেছে। এছাড়া বর্তমানে করমজল বণ্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে ৪৫৭টি কচ্ছপ রয়েছে। এবছর তিনটি বাটাগুর বাসকা মোট ৮২টি ডিম দিয়েছে। তা থেকে ৬৫টি বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। তিনি আরও জানান, বিশেষ ইনকিউভেশন বালুর নিচে রেখে ডিমগুলো ফোটানো হয়। বাচ্চা কচ্ছপগুলোকে প্রথমে পানির ট্যাংকে রেখে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হয়। পরে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানিয়ে নিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
সুন্দরবনের করমজল বণ্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে, দুটি কচ্ছপের ৬৩টি ডিম থেকে ৫৭টি বাচ্চা হয়। এরপর ২০১৮ সালে, দুটি কচ্ছপের ৪৬টি ডিম থেকে ২১টি বাচ্চা, ২০১৯ সালে, একটি কচ্ছপের ৩২টি ডিম থেকে ৩২টি বাচ্চা, ২০২০ সালে, দুটি কচ্ছপের ৫৬টি ডিম থেকে ৫২টি বাচ্চা, ২০২১ সালে, চারটি কচ্ছপের ৯৬টি ডিম থেকে ৭৯টি বাচ্চা, ২০২২ সালে, একটি কচ্ছপের ৩৪টি ডিম থেকে ৩৩টি বাচ্চ, ২০২৩ সালে, দুটি কচ্ছপের ৫২ ডিম থেকে ৫২টি বাচ্চা, ২০২৪ সালে তিনটি কচ্ছপের ৫৮ ডিম থেকে ৪২টি বাচ্চা ও সর্বশেষ ২০২৫ সালে, তিনটি কচ্ছপের ৮২টি ডিম থেকে ৬৫টি বাচ্চা ফোটে। এছাড়া ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২২ ও ২০২৪ সালে এই বাচ্ছা গুলো থেকে ১০৬টি কচ্ছপ সুন্দরবনের ভ্যান্তরের বিভিন্ন পুকুরসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অবমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের নদী-খালসহ আশপাশের এলাকা গুলোতে বাটাগুর বাসকার কোন স্ত্রীর কচ্ছপ রয়েছে কি না ও কচ্ছটির জীবন-আচারন জানতে বিভিন্ন সময় পিটে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসিয়ে ২১টি পুরুষ কচ্ছপ সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে এতে আশানরুপ কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি।
বাটাগুর বাসকা কচ্ছপের গড় আয়ু ৪০ বছর। এদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর লিঙ্গ নির্ধারণ করতে দীর্ঘ সময় লাগে। আজাদ কবির জানান, এই প্রজাতির কচ্ছপের লিঙ্গ নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করতে প্রায় ১৮ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। বর্তমানে করমজলে ১১টি পুরুষ ও ৪টি স্ত্রী কচ্ছপ শনাক্ত করা গেছে।
বাটাগুর বাসকার সংরক্ষণে এখন কাজ করছে বাংলাদেশ বন বিভাগ, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন, অস্ট্রিয়ার জু ভিয়েনা। এছাড়া বাটাগুর বাসকার সংরক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের টার্টল সারভাইভাল অ্যালায়েন্স ও যুক্ত ছিলো। তবে গত বছর (ঞঝঅ) এ চুক্তি শেষ হওয়ার কারনে তারা বর্তমানে এ কাজের সাথে যুক্ত নেই। ২০১৭ সাল থেকে যৌথভাবে এই প্রজাতির কচ্ছপের প্রজনন ও সংরক্ষণ গবেষণা শুরু হয়। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা ইনকিউবেশন পদ্ধতি, খাদ্যতালিকা এবং ডিমের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছেন বলে জানান, বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বাটাগুর বাসকার পুনর্জীবন বাংলাদেশের সংরক্ষণ ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই সফলতা প্রমাণ করে, সঠিক পরিকল্পনা ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচেষ্টায় হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
তিনি আরও বলেন, কচ্ছপের বাসস্থান পুনরুদ্ধার, শিকার রোধ ও জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে একদিন সুন্দরবনের নদীগুলোতে আবারও এই কচ্ছপের অবাধ বিচরণ দেখা যাবে। এছাড়া করমজল প্রজননকেন্দ্রে বর্তমানে ৪৫৭টির কচ্ছপ রয়েছে। তাদের মধ্যে থেকে বাছাইআকৃত কচ্ছপ গুলোকে ধীরে ধীরে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশে অবমুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া প্রজননকেন্দ্রের চারপাশে বালুময় ঘের তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রাপ্তবয়স্ক কচ্ছপগুলো ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ জায়গা পায়।
তিনি আশা প্রকাশ করে আরও বলেন, একসময় মনে হয়েছিল এই কচ্ছপ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন আমরা দেখছি, প্রজনন সম্ভব এবং বাচ্চাগুলো টিকে থাকছে। এটা বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়।
মারুফ বাবু, মোংলা প্রতিনিধিঃ 







































