
ইবি প্রতিনিধি:
ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রশাসনের মেয়াদ দেড় বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেড় বছরে কয়েকটি বিভাগে মাত্র ছয়জন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এতে তীব্র শিক্ষক সংকটে একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে অন্তত ১৪টি বিভাগের। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে সেশনজট।
অল্পসংখ্যক স্থায়ী শিক্ষক ও অন্যান্য বিভাগ থেকে ধার করা শিক্ষকদের মাধ্যমে চলছে এসব বিভাগ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কিছু বিভাগ সেশনজট কাটিয়ে উঠলেও মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে না। পাশাপাশি শিক্ষকদেরও অতিরিক্ত কোর্স পড়ানোর চাপ সামলাতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে মোট ৩৬টি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৪টি বিভাগ তীব্র শিক্ষক সংকটে ভুগছে। জুলাই আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও ইবিতে সেই তুলনায় উল্লেখযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বশেষ ফোকলোর স্টাডিজ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এবং ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে একজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় এসব নিয়োগ ন্যূনতম এবং শিক্ষক সংকট নিরসনে তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
এদিকে ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ এবং ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চে একটি করে শূন্যপদের বিপরীতে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন হলেও তা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে।
শিক্ষক সংকটে থাকা বিভাগগুলোর মধ্যে চারুকলা বিভাগে ৫ জন, সমাজকল্যাণ বিভাগে ৪ জন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ৫ জন, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগে ৪ জন, ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগে ৫ জন, ল’ অ্যান্ড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে ৫ জন, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ৪ জন, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে ৫ জন, শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগে ২ জন, বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ৫ জন, ফার্মেসি বিভাগে ৬ জন, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগে ৩ জন, মার্কেটিং বিভাগে ৫ জন এবং এনভায়রনসেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড জিওগ্রাফি বিভাগে ৪ জন শিক্ষক রয়েছেন।
প্রতিটি বিভাগে ৬-৭টি ব্যাচ অধ্যয়নরত থাকায় বিভাগীয় কার্যক্রম সচল রাখতে বাধ্য হয়ে অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকদের ধার নিতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার শিক্ষক নিয়োগের দাবি জানালেও কার্যত কোনো সুরাহা মেলেনি। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগের দাবিতে গত ৯ সেপ্টেম্বর মানববন্ধন করেন চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া এরআগে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাতটি বিভাগে দ্রুত শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করেছেন শিক্ষকরা।
রেজিস্ট্রার দপ্তর সূত্রে, চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রশাসন ২১টি বিভাগে মোট ৫৯টি শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলে আবেদন করেন প্রার্থীরা। তবে এসব নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইউজিসির অর্থছাড়ের পূর্বানুমতি না নেওয়ায় নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করে। পরে ইউজিসি শিক্ষক সংকট বিবেচনায় ছয়টি বিভাগে মাত্র ছয়টি পদে অর্থছাড় অনুমোদন দিলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ নতুন করে এই ১৪টি বিভাগসহ দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক পদসহ মোট ২৮ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই পদগুলো দ্রুত পূরণ করার দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিভাগীয় সভাপতিদের অভিযোগ, প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব ও অব্যবস্থাপনায় শিক্ষক সংকট নিরসন হচ্ছে না। তারা বলেন, অ্যাকাডেমিক অচলাবস্থা ও সেশনজট কাটাতে অতিদ্রুত পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হোক।
ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী পংকজ রায় বলেন,” শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার্থীদের সেশনজটে পড়তে হচ্ছে। আমরা অলরেডি মাস্টার্সে ১ বছর সেশনজটে পড়ে গেছি। গেস্ট শিক্ষকদের দিয়ে ক্লাস নেওয়া হয় অনেক সময়। শিক্ষার্থীরা যেমন শিক্ষক আশা করেন, তেমন শিক্ষক দ্বারা ক্লাস পান না। আমাদের ফোকলোর বিভাগে অনেক সময় ইংরেজি বা আরবি বিভাগের শিক্ষকরা এসে ক্লাস নেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষক সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।”
জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের সরকারী অধ্যাপক ইনজামুল হক নিয়োগ সংক্রান্ত প্রকাশিত একটি নিউজের কমেন্টে বলেন, আমি শিক্ষকতা করি সেই বিভাগ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ৮ বছরে ২০১৮ সালে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। এরপর গত ৭ বছরে কোন শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। বিগত ভাইস চ্যান্সেলরের সময় ১ বার এবং পরবর্তিতে ১ বার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হয়ে আবেদন জমা পড়লেও যাচাই বাছাই সত্বেও তা বিভিন্ন জটিলতার দায়ে আলোর মুখ দেখেনি। উপরিউন্তু বিভাগের একাধিক শিক্ষক একাডেমিক ডিগ্রী অর্জনের জন্য বিভিন্ন সময় শিক্ষা ছুটিতে থেকেছেন, এমনও সময় গেছে যখন মাত্র ২ জন শিক্ষক দিয়ে বিভাগের কার্যক্রম চলেছে। পাশাপাশি ৮ বছরে বিভাগে একজন সাধারন কর্মচারী, ল্যাব সংক্রান্ত জনবল নিয়োগ হয়নি।
বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত একটি বিভাগের প্রতি সেমিস্টারে থিওরী ল্যাব মিলিয়ে ৮/৯ টি কোর্স পরিচালনা করতে হয় সেই হিসেবে ৬ টি শিক্ষাবর্ষের কোর্স সংখ্যা প্রায় ৫০ টি, এছাড়াও ফিল্ডওয়ার্ক/ট্রেনিং তো আছেই। বিভিন্ন সময় গেস্ট টিচার ও পার্ট টাইম টিচার মিলিয়ে জোড়া তালি দিয়ে কোনোরকম বিভাগ চলছে, সে ক্ষেত্রেও নানা রকম জটিলতা তো আছেই।
জুলাই আন্দোলনের পরে নতুন অনেক বিভাগে এক বা একাধিক নিয়োেগ হলেও আমাদের বিভাগে নিয়োগের কোনও নাম গন্ধ খুজে পাইনি। খোজ নিয়ে দেখবেন আমার বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বিভাগ যেই বিভাগের সামন্জস্যপূর্ণ কোনও বিভাগ ইবিতে নেই, অথচ এই বিভাগই একমাত্র বিভাগ যেই বিভাগে ৮ বছরে কোনও নতুন নিয়োগ হয়নি।
বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৫০ জন, শিক্ষক সংখ্যা ৪ জন, শিক্ষার্থী শিক্ষক অনুপাত ৬২:১। প্রশাসন থেকে সেশন জট নির্মূলের চাপ তো আছেই। এই ৪ জন শিক্ষকের উপর যেই পরিমাণে শারীরিক এবং মানসিক চাপ বর্তায় তার হিসেব হয়ত মিলানো যাবেনা। বর্তমান সময়ে সবাই বিভাগ এবং শিক্ষকদের দোষ খুজতেই ব্যস্ত থাকে কিন্তু এরকম শত শত শিক্ষকদের নিরুপায় বোবা কান্নার খোঁজ কেউ রাখেনা। কারও কাছে খারাপ লাগলে পাগলের প্রলাপ ভেবে নিজ গুণে ক্ষমা করে দিবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ হাজার ৮০ জন শিক্ষকের প্রয়োজন থাকলেও মাত্র ৪০৫ জন শিক্ষক রয়েছে। অ্যাক্রিডিটেশনের ন্যূনতম শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এছাড়া ইবির বিভিন্ন বিভাগে মাত্র দুই-তিনজন শিক্ষক অনেকগুলো কোর্স পড়াচ্ছেন। এটি ইউজিসির ক্লাস লোড পলিসির পরিপন্থি।
এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, “যে সকল বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে আমরা তা অবগত রয়েছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংকট নিরসনের জন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
ইবি প্রতিনিধি: 







































