
‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’ লেখা টুপি পরা ৭৮ বছরের বৃদ্ধ গ্যারি কোবিনের পূর্বপুরুষ যে ভিয়েনা থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি নিধনের সময় আমেরিকায় পালিয়ে এসেছিল, সেটা জানতে পারি আমাদের আলাপের শেষ দিকে। শুরুতে ভেবেছিলাম নির্বাচন নিয়ে মামুলি কিছু প্রশ্ন করব। কিন্তু গ্যারির জীবনকাহিনি বিশ্বসাহিত্যের সেরা যেকোনো উপন্যাসের গল্পকে হার মানায়।
আজকের আশি ছুঁইছুঁই বৃদ্ধ গ্যারির মা-বাবার বিচ্ছেদ ঘটে যখন, তখন সে কোলের শিশু। তার মা ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে নিউইয়র্কে চলে আসেন গ্যারিকে নিয়ে এবং একক মা হিসেবেই সন্তানকে বড় করেন। একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে গ্যারি ‘মেরিন কোর’-এ নাম লেখান এবং ১৯৬৬-৬৮ সাল পর্যন্ত ‘মেরিন কোর’-এ কাজ করার পর ১৯৭০-৭১ নাগাদ মার্কিন সরকারের ডাক বিভাগে কাজ করেন। বাকি জীবন প্রাইভেট সেক্টরের নানা পেশায় কাজ করা গ্যারির শেষ পেশা ছিল বিত্তবানের কুকুরকে হাঁটানোর কাজ। এ জন্য তিনি নিয়মিত বেতন পেতেন। বেশ কয়েক বছর সার্কাসে ‘ক্লাউন’ হিসেবেও কাজ করেছেন। গাড়ি বিক্রি থেকে ফুড স্টোরে কাজ করাসহ বিচিত্র পেশাজীবন ছিল তার। বর্তমানে ‘সোশ্যাল সিকিউরিটি’ এবং সরকারের কাছ থেকে নৌবাহিনীর সাবেক সদস্য হিসেবে পাওয়া ক্ষুদ্র পেনশনের ওপর জীবন নির্বাহ করছেন। সত্তরের দশকে একবারই বিয়ে করেছিলেন, যা ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। নিঃসন্তান গ্যারির সঙ্গে বছর বিশেক আগে অনেক খুঁজে যোগাযোগ করেন তার বৈমাত্রেয় বোন। বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে এক বৈমাত্রেয় বোন ও ভাই আছে তার। স্নেহময়ী বোনের সঙ্গেও এই মুহূর্তে সম্পর্ক ভালো নয় গ্যারির। যেহেতু তার বোন দুই ভাইকে ভালোবাসলেও গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞকে ‘ধীরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা’ হিসেবে দেখছে এবং একে ‘গণহত্যা’ হিসেবে মানতে নারাজ। নিজেকে গ্যারি ইহুদিও বলেন না। বলেন, ‘আওয়ার ফোরফাদার্স হ্যাড হিব্রু অরিজিন বাট আই অ্যাম নট রিলিজিয়াস।’
জীবনে কখনোই কোনো সিনাগগে না যাওয়া গ্যারি বেড়ে উঠেছিলেন ‘ডেমোক্র্যাট রাজনীতিতে আস্থাবান শিশু’ হিসেবে। কিন্তু দেখতে দেখতে ডেমোক্র্যাটরাও যখন ক্রমাগত রিপাবলিকাদের মতোই ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’র কাছে আত্মসমর্পণ করা শুরু করল, গ্যারিও পিছু হঠতে শুরু করলেন। ‘কমিউনিজমে বিশ্বাসী একজন সোশ্যালিস্ট হিসেবে আমি এখন গ্রিন পার্টির সমর্থক। সবাই এই দলকে ভালো বা নীতিবান বললেও কেউ ভোট দেয় না। তাহলে আর কাকে ভোট দেব? যুদ্ধ আর জলবায়ু পরিবর্তনই বর্তমান মানবসভ্যতার প্রধান দুটো অস্তিত্বগত সংকট। কিন্তু সব জেনেশুনেও জো বাইডেন গাজায় যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলছেন না। কমলাও তাই। এই পার্টিগুলো সব করপোরেটের পার্টি। আর ট্রাম্পের বিষয়ে কী আর বলা যায়? এমনিতে ডেমোক্র্যাটরা এখনো কিছুটা জনমুখী, কিন্তু গাজার গণহত্যার কারণে আর কীভাবে সমর্থন করি? সব মার্কিন নাগরিক মন্দ নয়- শতকরা সত্তর ভাগ মার্কিনি গাজায় গণহত্যার পক্ষে নয়।’
‘গ্রেট আমেরিকান ড্রিম’-এর দামি গাড়ি-বাড়ি-সুন্দরী স্ত্রীর মন্ত্রে নাম লেখাতে গররাজি বৃদ্ধ গ্যারির দিন কাটে সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে, মাউথ অরগান বাজিয়ে ও বই পড়ে। ইংরেজি ছাড়াও পর্তুগিজ ভাষা জানেন আর ভারতীয় রবিশঙ্করের সেতারও শুনেছেন বলে জানালেন। ৭৮ বছরের এই বৃদ্ধের একটি বাইপাস সার্জারি হবে শিগগিরই। নৌবাহিনীর সাবেক চাকুরে হিসেবে যে হাসপাতালে বিনা খরচে সব সেবা পান, এই ‘বৈষম্য’ নিয়েও খানিকটা লজ্জিত তিনি।
গ্যারির সুরেই সুর মিলিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক হলেও গাজা গণহত্যার নিন্দা করলেন ২৪ বছরের মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন তরুণী দামারিস ফ্রাঙ্কো। দামারিসের মেক্সিকান মা-বাবা এ দেশে চলে আসেন তার জন্মের আগেই। একটি কমিউনিটি কলেজে ‘ব্যবহারিক মনস্তত্ত্বে’র ছাত্রী দামারিস পড়াশোনার পাশাপাশি ‘বিহেভিয়ারাল থেরাপিস্ট’ হিসেবে বয়ঃসন্ধিক্ষণের শিশু-কিশোরদের সঙ্গে কাজ করেন। মাসে ৮০০ ডলারের মতো আয় তার; থাকেন মা-বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে।
‘আমি এবারই প্রথম ভোট দেব। ২০২০ নাগাদ ভোটার হলেও কাগজপত্রে কিছু সমস্যা হয়েছিল। ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেব যেহেতু আমরা কালার্ড পিপল’, নাক-মুখের আদলে ও উচ্চতায় খানিকটা আমাদের দেশের গারো মেয়েদের মতো দেখতে দামারিস বলেন।
‘অভিবাসী’ হিসেবে এ দেশে কোনো সমস্যা হয় কি না জিজ্ঞাসা করলে বলেন, ‘অবশ্যই হয়। আমাদের অনেকেই খুব ঘৃণা করে। একে আমি হিস্পানিক অভিবাসী, তাতে নারী- ডেমোক্র্যাট ছাড়া কাকেই বা সমর্থন করব? তবে এই যে ডেমোক্র্যাটরা এবার গাজায় গণহত্যা চালানো যুদ্ধকে রীতিমতো ফান্ড করছে, এটা খুব দুঃখজনক। কিন্তু রিপাবলিকানদেরই-বা কীভাবে সমর্থন করি? আমার বাবা মেয়েদের প্রশ্নে ক্রিশ্চিয়ান কড়া নীতির জন্য রিপাবলিকানদের সমর্থন করা শুরু করেছিলেন। কিন্তু গত পরশু ট্রাম্পের ম্যাডিসন স্কয়ারের র্যালিতে হিস্পানিকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করার পর মত বদলাচ্ছেন। এবার যেন কেমন- সাদা নারীরা ট্রাম্পকে সমর্থন দিচ্ছেন।
হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনের দিন আসতে আর মাত্র সাত দিন বাকি। এর ভেতর সবচেয়ে বেশি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে উইসকনসিন, মিনেসোটা, মিশিগান এবং নর্থ ক্যারোলাইনায়। তবে জনমত জরিপগুলোর কোনোটিতে হ্যারিসকে আবার কোনোটিতে ট্রাম্পকে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। যেমন ৮ হাজার ৮০৭ ভোটারের ভেতর পরিচালিত জরিপে ট্রাম্প ৪৭ শতাংশ এবং হ্যারিস ৫০ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন দেখালেও রয়টার্সের নতুন এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, হ্যারিস পিছিয়ে পড়ছেন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীই শেষ মুহূর্তের জনসংযোগ, র্যালি, সমাবেশে ব্যস্ত। মার-আ-লাগোতে ট্রাম্প গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এবং সন্ধ্যায় ফিলাডেলফিয়া থেকে ৬০ মাইল দূরবর্তী পেনসিলভানিয়ার অ্যালেনটাউনে ট্রাম্প একটি সন্ধ্যাকালীন র্যালিতে অংশ নেন। অন্যদিকে ওয়াশিংটন ডিসিতে হ্যারিসের একটি র্যালিতে অংশ নেওয়ার কথা।
এ বছর মার্কিনি ভোটাররা অর্থনৈতিক দুর্দশার পুনরুদ্ধার, জাতীয় নিরাপত্তা, অপরাধ ও অভিবাসনজাতীয় প্রশ্নে রিপাবলিকানদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মেয়েদের গর্ভপাতের অধিকারজাতীয় প্রশ্নগুলোয় ডেমোক্র্যাটদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছেন।
মঙ্গলবার রয়টার্স ৯৭৫ জন নিবন্ধিত ভোটারসহ মোট ১ হাজার ১৫০ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপ অনুযায়ী হ্যারিসের প্রতি জনসমর্থনের হার যেখানে ৪৪ শতাংশ, ট্রাম্পের সেখানে ৪৩ শতাংশ। গত জুলাই থেকে ‘রয়টার্স’ পরিচালিত প্রতিটি জনমত জরিপে কমলা এগিয়ে থাকলেও সেপ্টেম্বর থেকে দেখা যাচ্ছে কমলা ও ট্রাম্পের ভেতর দূরত্ব কমে আসছে।
এদিকে নর্থ ক্যারোলিনায় সম্ভাব্য ভোটদাতাদের ভেতর ২৩-২৬ অক্টোবর নাগাদ পরিচালিত অনলাইনে আরেকটি জরিপে দেখা যায় যে দুই প্রার্থীই ৪৭ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে এ ওর ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন আর মাত্র ২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে তারা তৃতীয় কোনো দলকে ভোট দেবেন এবং ৪ শতাংশ উত্তরদাতা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
এদিকে ‘টাইটানিক’খ্যাত হলিউডের চির নবীন ও রোমান্টিক অভিনেতা লিওনার্দো ডি’ক্যাপ্রিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে ‘বিজ্ঞানকে অস্বীকার করা’ এবং ‘তথ্য-উপাত্ত অস্বীকার করা’র দায়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিবর্তে কমলা হ্যারিসের পক্ষেই তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। এর আগেও তিনি ২০২০-এর নির্বাচনে জো বাইডেনকে সমর্থন করেছিলেন।
ডি’ক্যাপ্রিও তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে জানান, যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেখে তিনি চিন্তিত, ‘এ মাসের শুরুতে হারিকেন হেলেন এবং মিল্টন ফ্লোরিডা, জর্জিয়া এবং নর্থ ক্যারোলিনার কিছু অংশে প্রবল আঘাত হানে। বহু পরিবার গৃহহীন হয়েছে, আটলান্টিকের অন্যতম শক্তিশালী এই হারিকেনের কারণে জীবিকা ও প্রিয়জন হারিয়েছেন আরও অনেকে। আমাদের প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
অথচ ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব স্বীকার করতে চান না। তিনি ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন,’ বলেন ‘কিলার্স অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন’-এর এই অভিনেতা।
‘আমাদের অর্থনীতি, গ্রহ এবং নিজেদের সুরক্ষায় দরকার সাহসী পদক্ষেপ। সে জন্যই আমি কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে যাচ্ছি। মার্কিনি ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু সুরক্ষাসংক্রান্ত পদক্ষেপ নিতে তিনি সাহায্য করেছেন। তার নেতৃত্বেই ২০৫০ সাল নাগাদ কার্বন নিঃসরণের ক্ষেত্রে শূন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ আমাদের একটি সবুজ অর্থনীতি পেতে সাহায্য করবে, যা শুধু নতুন কাজেরই সৃষ্টি করবে না, বরং আমাদের গ্রহকে বাঁচাতেও সাহায্য করবে।’
ডি’ক্যাপ্রিওর পাশাপাশি সারাহ জেসিকা পার্কার, অ্যান হ্যাথওয়ে, মার্থা স্টিওয়ার্ট এবং ব্রায়ান ক্রানস্টন, টেইলর সুইফট, ব্রুস স্প্রিংস্টিনসহ বহু মার্কিনি সেলিব্রিটিই হ্যারিসকে সমর্থন করছেন। অন্যদিকে মেল গিবসনের মতো আজও বিখ্যাত তারকাদের কেউ কেউ সমর্থন করছেন ট্রাম্পকে।
আন্তর্জাতিক ডেস্ক 







































