শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শিশুদের সুরক্ষা ও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের প্রাসঙ্গিকতা

৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Protecting Children from Tobacco Industry Interference’. বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’। এবারে যে থিম নির্ধারণ করা হয়েছে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। আজকের আলোচনায় সেটিই তুলে ধরতে চায়। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ; তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
২০২২ সালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী, ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩৭ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ১২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর ধূমপান করে থাকে; যাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। ধূমপানে আসক্ত এই শিশুদের ৭৫ ভাগ ছেলে আর ২৫ ভাগ মেয়ে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা ৩৯ দশমিক ১, যা ২০১৯ সালেও ছিল ৩৫ শতাংশ। এখন ছেলেদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে এ সংখ্যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। ধূমপানে বিশ্বের মধ্যে আমাদের অবস্থান অষ্টম।
বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে প্রতি বছর তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং বছরে ৬১ হাজার শিশু তামাকের পরোক্ষ ক্ষতির শিকার হয়। এতে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন আরও ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের বিরাট অংশ ধূমপানের বিষক্রিয়ার শিকার। ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন আছে। পরোক্ষ ধূমপান নিকোটিন উপস্থিতির কারণ।
যে তথ্য-উপাত্ত এখানে উল্লেখ করা হলো, বুঝতেই পারছেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, আমাদের শিশুরা প্রাণ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। আর এদেরকে এই প্রাণনাশক ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলি। কেন তারা শিশুদেরকে তাদের প্রধানতম টার্গেটে পরিণত করছে? আমারা সেই উত্তরটি এখন খোঁজার চেষ্টা করবো।
তামাক কোম্পানির প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা লাভের বিনিময়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাক সেবনের কারণে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। অর্থাত প্রতি বছর তামাক কোম্পানির ১ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহক বা ক্রেতা কমে যায়। তাদের ব্যবসায়িক টার্গেট থাকে যে ক্রেতা কমে গেলো তার প্রতিস্থাপন করা। সেটি প্রতিস্থাপন না করলে তাদের হাজার কোটি টাকার মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়।
এই প্রতিস্থাপনের প্রধান টার্গেট হয় শিশুরা। এটি তাদের একটি বৈশ্বিক কৌশল। এটার জন্য কেন তারা এই কমোলমতি শিশুদেরকেই টার্গেট করে? কারণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যে কখনও তামাক সেবন করে নাই তাকে তার পরিণত বয়সে তামাকের নেশায় আসক্ত করে তোলা অনেক বেশি কঠিন। পক্ষান্তরে একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে অতি সহজেই তামাকের নেশায় আসক্ত করে ফেলা সম্ভব হয়।
শিশুটিকে যদি একবার তামাকের নেশায় আসক্ত করে দেয়া যায় তাহলে ঐ শিশুই হয়ে যায় তাদের লাইফটাইম ক্রেতা। অর্থাত সে তার পরিণত বয়সে যতোদিন বেচে থাকে ততোদিন পর্যন্ত কম-বেশি তামাক সেবন করে। এবং একসময় তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তামাক কোম্পানিগুলি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তামাক গ্রহণের প্রতি প্রলুব্ধ করে, তার জন্য সহজভাবে যাতে তামাক তাদের হাতে পৌছায় এবং সাশ্রয়ী মূল্যে যাতে তারা নিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।
তামাক কোম্পানি এজন্য এমন পণ্য এবং বিজ্ঞাপনের কৌশলও তৈরি করে যা শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের কাছে মানসিকভাবে তামাক গ্রহণের জন্য আবেদন তৈরি করে। বর্তমান সময়ে তাদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৌঁছানো তামাক কোম্পানির জন্য অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে।
তামাক কোম্পানির যে অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করলাম সেগুলি বাংলাদেশের বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বৈধতা দেয় না; কিছু ক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ তারা গ্রহণ করে। এবং এজন্য বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে তারা বেপরোয়াভাবে আইন লঙ্ঘন করে। এগুলি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে প্রভাবিত করার চেষ্টায় থাকে।
দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই সিগারেটের দোকান দেখা যায়। এই দোকানগুলি এখানে স্থাপনের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির হাত থাকে। কারণ তাহলে ঐ অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীর জন্য সিগারেট পাওয়া সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বিষয়টি সরকারের বিবেচনতা আসার কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা” নামে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে।
এই নির্দেশিকাটিতে উল্লেখ করা হয়, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে হলে স্বতন্ত্র লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। এবং লাইসেন্স প্রদানের শর্ত হিসাবে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। অর্থাত এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় অবৈধ। শিশুদেরকে তামাক কোম্পানির হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যেই সরকার এমন একটি ধারা সংযুক্ত করেছে।
এই ধারাটি বাতিলের জন্য তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নানাধরণের অপতৎপরতা পরিচালনা করে। এই অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে হয়। তাদের প্রতিবাদ এবং মন্ত্রণালয়ের দৃঢ়তার কারণে কোম্পানির সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
তামাক কোম্পানির বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অপতৎপরতা পরিলক্ষিত হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তার ধারাবাহিকতাতে আইনটিকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এবং সংযুক্তি এনে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে সরকারের কাছে।
এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংশোধনীতে শিশুদেরকে তামাক কোম্পানির হাত থেকে সুরক্ষা করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা; তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা; সিঙ্গেল স্টিক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। সিঙ্গেল স্টিক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে শিশুদের পক্ষে সিগারেট ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে হয়ে উঠবে।
সুনির্দিষ্টভাবে আইনের এই সংশোধনীগুলির বিরোধিতা করে তামাক কোম্পানিগুলি আইন সংশোধনের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। আইনটির সংশোধনী গত সরকারের সময়ে পাশ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও চূড়ান্ত সময়ে এস আটকে যায়। এখনও পর্যন্ত সেটি সংশোধনের অপেক্ষা তালিকায় থেকে গেছে তামাক কোম্পানীর অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে।
অথচ এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে তামাক কোম্পানির এধরণের হস্তক্ষেপ অবৈধ। এটি যে তারা শুধুমাত্র বাংলাদেশে করছে এমনটি নয়। সারা বিশ্বেই করছে। তবে আমাদের এখানে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। আমাদের আশার অন্যতম জায়গা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “২০৪০ সালের পূর্বেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া”র ঘোষণা দিয়েছেন।
তাঁর এই ঘোষণা এমনি এমনি বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘোষণাটি বাস্তবায়নের জন্য উল্লেখিত সংশোধনীগুলি অপরিবর্তিত রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। আর এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হলে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ আমাদেরকে প্রতিহত করতেই হবে। এই অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অর্থাত দেশের জনস্বাস্থ্য এই হায়েনার মরণ কবল থেকে রক্ষা পাবে।

শিশুদের সুরক্ষা ও তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপের প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশের সময় : ০৭:০৩:৪৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ মে ২০২৪

৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘Protecting Children from Tobacco Industry Interference’. বাংলায় ভাবানুবাদ করা হয়েছে ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’। এবারে যে থিম নির্ধারণ করা হয়েছে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। আজকের আলোচনায় সেটিই তুলে ধরতে চায়। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ; তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা আমাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
২০২২ সালের তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী, ১৩-১৫ বছর বয়সী অন্তত ৩৭ মিলিয়ন শিশু কোনো না কোনো ধরনের তামাক ব্যবহার করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের প্রায় ১২ শতাংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোর ধূমপান করে থাকে; যাদের অধিকাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। ধূমপানে আসক্ত এই শিশুদের ৭৫ ভাগ ছেলে আর ২৫ ভাগ মেয়ে।
ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউয়ের ২০২৩ সালের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ওপরে ধূমপায়ীর সংখ্যা শতকরা ৩৯ দশমিক ১, যা ২০১৯ সালেও ছিল ৩৫ শতাংশ। এখন ছেলেদের মধ্যে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৬০ দশমিক ৬ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে এ সংখ্যা ১৭ দশমিক ৭ শতাংশ। মেয়েদের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ৭ শতাংশের মতো। ধূমপানে বিশ্বের মধ্যে আমাদের অবস্থান অষ্টম।
বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে প্রতি বছর তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় এবং বছরে ৬১ হাজার শিশু তামাকের পরোক্ষ ক্ষতির শিকার হয়। এতে কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন আরও ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ।
২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর অক্সফোর্ড থেকে প্রকাশিত নিকোটিন অ্যান্ড টোব্যাকো রিসার্চ সাময়িকীতে সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শিশুদের বিরাট অংশ ধূমপানের বিষক্রিয়ার শিকার। ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আশপাশ এলাকার ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে ক্ষতিকর নিকোটিন আছে। পরোক্ষ ধূমপান নিকোটিন উপস্থিতির কারণ।
যে তথ্য-উপাত্ত এখানে উল্লেখ করা হলো, বুঝতেই পারছেন আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, আমাদের শিশুরা প্রাণ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। আর এদেরকে এই প্রাণনাশক ঝুঁকির মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানিগুলি। কেন তারা শিশুদেরকে তাদের প্রধানতম টার্গেটে পরিণত করছে? আমারা সেই উত্তরটি এখন খোঁজার চেষ্টা করবো।
তামাক কোম্পানির প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা লাভের বিনিময়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাক সেবনের কারণে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় যা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। অর্থাত প্রতি বছর তামাক কোম্পানির ১ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহক বা ক্রেতা কমে যায়। তাদের ব্যবসায়িক টার্গেট থাকে যে ক্রেতা কমে গেলো তার প্রতিস্থাপন করা। সেটি প্রতিস্থাপন না করলে তাদের হাজার কোটি টাকার মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়।
এই প্রতিস্থাপনের প্রধান টার্গেট হয় শিশুরা। এটি তাদের একটি বৈশ্বিক কৌশল। এটার জন্য কেন তারা এই কমোলমতি শিশুদেরকেই টার্গেট করে? কারণ একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যে কখনও তামাক সেবন করে নাই তাকে তার পরিণত বয়সে তামাকের নেশায় আসক্ত করে তোলা অনেক বেশি কঠিন। পক্ষান্তরে একটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুকে অতি সহজেই তামাকের নেশায় আসক্ত করে ফেলা সম্ভব হয়।
শিশুটিকে যদি একবার তামাকের নেশায় আসক্ত করে দেয়া যায় তাহলে ঐ শিশুই হয়ে যায় তাদের লাইফটাইম ক্রেতা। অর্থাত সে তার পরিণত বয়সে যতোদিন বেচে থাকে ততোদিন পর্যন্ত কম-বেশি তামাক সেবন করে। এবং একসময় তামাকজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, তামাক কোম্পানিগুলি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তামাক গ্রহণের প্রতি প্রলুব্ধ করে, তার জন্য সহজভাবে যাতে তামাক তাদের হাতে পৌছায় এবং সাশ্রয়ী মূল্যে যাতে তারা নিতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে।
তামাক কোম্পানি এজন্য এমন পণ্য এবং বিজ্ঞাপনের কৌশলও তৈরি করে যা শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের কাছে মানসিকভাবে তামাক গ্রহণের জন্য আবেদন তৈরি করে। বর্তমান সময়ে তাদের কাছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পৌঁছানো তামাক কোম্পানির জন্য অনেক বেশি সহজ হয়ে গেছে।
তামাক কোম্পানির যে অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করলাম সেগুলি বাংলাদেশের বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বৈধতা দেয় না; কিছু ক্ষেত্রে আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ তারা গ্রহণ করে। এবং এজন্য বিভিন্ন কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে তারা বেপরোয়াভাবে আইন লঙ্ঘন করে। এগুলি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে প্রভাবিত করার চেষ্টায় থাকে।
দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশেই সিগারেটের দোকান দেখা যায়। এই দোকানগুলি এখানে স্থাপনের ক্ষেত্রে তামাক কোম্পানির হাত থাকে। কারণ তাহলে ঐ অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীর জন্য সিগারেট পাওয়া সহজলভ্য হয়ে ওঠে। বিষয়টি সরকারের বিবেচনতা আসার কারণে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে “স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকা” নামে একটি নির্দেশিকা প্রকাশ করে।
এই নির্দেশিকাটিতে উল্লেখ করা হয়, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় করতে হলে স্বতন্ত্র লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। এবং লাইসেন্স প্রদানের শর্ত হিসাবে বলা হয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ১০০ মিটারের মধ্যে লাইসেন্স প্রদান করা যাবে না। অর্থাত এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় অবৈধ। শিশুদেরকে তামাক কোম্পানির হাত থেকে সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যেই সরকার এমন একটি ধারা সংযুক্ত করেছে।
এই ধারাটি বাতিলের জন্য তামাক কোম্পানির পক্ষ থেকে মন্ত্রণালয় ও সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে নানাধরণের অপতৎপরতা পরিচালনা করে। এই অপতৎপরতা বন্ধ করার জন্য তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে হয়। তাদের প্রতিবাদ এবং মন্ত্রণালয়ের দৃঢ়তার কারণে কোম্পানির সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি।
তামাক কোম্পানির বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কিছু সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে অপতৎপরতা পরিলক্ষিত হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। তার ধারাবাহিকতাতে আইনটিকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী এবং সংযুক্তি এনে আইনটি সংশোধনের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে সরকারের কাছে।
এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংশোধনীতে শিশুদেরকে তামাক কোম্পানির হাত থেকে সুরক্ষা করার জন্য উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা; তামাকজাত দ্রব্য বিক্রেতাদের লাইসেন্সের আওতায় আনা; সিঙ্গেল স্টিক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা। সিঙ্গেল স্টিক বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হলে শিশুদের পক্ষে সিগারেট ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে হয়ে উঠবে।
সুনির্দিষ্টভাবে আইনের এই সংশোধনীগুলির বিরোধিতা করে তামাক কোম্পানিগুলি আইন সংশোধনের কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকারের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। আইনটির সংশোধনী গত সরকারের সময়ে পাশ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও চূড়ান্ত সময়ে এস আটকে যায়। এখনও পর্যন্ত সেটি সংশোধনের অপেক্ষা তালিকায় থেকে গেছে তামাক কোম্পানীর অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে।
অথচ এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে তামাক কোম্পানির এধরণের হস্তক্ষেপ অবৈধ। এটি যে তারা শুধুমাত্র বাংলাদেশে করছে এমনটি নয়। সারা বিশ্বেই করছে। তবে আমাদের এখানে তাদের প্রভাব অনেক বেশি। আমাদের আশার অন্যতম জায়গা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী “২০৪০ সালের পূর্বেই তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়া”র ঘোষণা দিয়েছেন।
তাঁর এই ঘোষণা এমনি এমনি বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘোষণাটি বাস্তবায়নের জন্য উল্লেখিত সংশোধনীগুলি অপরিবর্তিত রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে। আর এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হলে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ আমাদেরকে প্রতিহত করতেই হবে। এই অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অর্থাত দেশের জনস্বাস্থ্য এই হায়েনার মরণ কবল থেকে রক্ষা পাবে।